“সাংবিধানিক জটিলতা” বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত শব্দ গুচ্ছ। সংবিধান রচনার দিন থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশ যেন সাংবিধানিক জটিলতার কুটিল প্যাঁচ থেকে বের হতে পারছে না। এ প্যাঁচ থেকে যতবারই বের হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, দেশ ও জাতি নতুন প্যাঁচে আটকা পড়েছে। সাংবিধানিক মারপ্যাঁচের জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে দেশের মানুষ।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। অনুভূত হয় নব্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য একটা কার্যকর সংবিধান প্রণয়নের। ১০ ই জানুয়ারি ১৯৭২, শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে সংবিধান রচনার কাজে মনোনিবেশ করেন। তবে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণপরিষদ গঠনের পরিবর্তে ১৯৭০ সালের গণপরিষদের নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন করতে চটজলদি তৎপরতা শুরু করে দেন। এক প্রলম্বিত সমস্যার সূত্রপাত ঘটানো হয় এখান থেকেই।
১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে ৩৪ সদস্যদের সমন্বয়ে খসড়া সংবিধান কমিটি প্রণয়ন করা হয়। এই কমিটিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়া ৩৩ জন সদস্যই ছিলেন আওয়ামী লীগের।
ড. কামালের নেতৃত্বাধীন খসড়া কমিটি সর্বমোট ৪৭ টি বৈঠক এবং ৩০০ ঘন্টা সময় ব্যয় করে সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করেন। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ অতি গর্বের সঙ্গে বলতে থাকেন যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচনা করতে মাত্র ৩২৫ দিন, অর্থাৎ এক বছরের কম সময় লেগেছে। যদিও কামাল হোসেন বলেছেন,” রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের চেয়েও পাকিস্তানের সংবিধান লিখবার অনুমান ও ধারণা থেকেই বাহাত্তরে বাংলাদেশের সংবিধান লেখা হয়েছে”। অর্থাৎ, বাহাত্তরে সংবিধান মূলত পাকিস্তানের জন্য রচিত সংবিধানের সংশোধিত সংস্করণ।
জনাব কামাল তার বইতে লিখেছেন, “This is the important remembering -the 325 days is not very short because there had been at least a couple of years preparation ”.
বাহাত্তরের সংবিধান পড়লে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আওয়ামী ল্যাসপেন্সার ড. কামালের নেতৃত্বাধীন খসড়া কমিটি শেখ মুজিবুর রহমানকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে ‘রাজাধিরাজ’ হিসেবে পরিগণিত করাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ৭২ থেকে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবের শাসনামল বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশ মুজিবাদের ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত হয়। বাংলাদেশের মানুষকে দেখতে হয় এক দানবীয় শাসনতন্ত্র, যেখানে রাজাধিরাজ মুজিবের কথাই সর্বোচ্চ আইন হিসেবে অবধারিত ছিল যা সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রটিকে পুরোপুরি তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৫৪ বছরের ইতিহাসে সংবিধান সতেরো বার পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিটি সংশোধনী পুরোনো সমস্যার সমাধান যতটা করেছে, তার চেয়ে নিত্য নতুন সমস্যার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। প্রতিটি ক্ষমতাসীন দল সংবিধানকে ক্ষমতার অপব্যবহারের দলিল হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিদ্যমান সংবিধানের মাধ্যমেই ১৯৭৪ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে। আবার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে বাহাত্তরে বিতর্কিত মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সর্বমহলের গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বাকশাল-২.০ কায়েমের যাবতীয় বন্দোবস্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এরফলে, দীর্ঘ ষোলটি বছর দেশ দুর্বৃত্তায়নের ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত হয়। আওয়ামী দুঃশাসনের চাদরে ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
আওয়ামী দুঃশাসনের দীর্ঘ এই পটপরিক্রমায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এক দুঃসময় অতিবাহিত করে এসেছে। জামায়তসহ শরীক দলগুলোকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল করার জন্য পুরোটা সময় রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। তবে আশার কথা হলো যে গত বছরের জুলাই আগস্টের “বর্ষা বিপ্লব “আমাদের জাতীয় সংকট নিরসনের এক অবারিত সুযোগের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে সাংবিধানিক জটিলতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। জনপরিসরে বাহাত্তরের পুরোনো বন্দোবস্তের জরাজীর্ণ সংবিধান সংস্কার ও বাতিল করার দাবি নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে, এনসিপি, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মতো সংগঠনগুলো পুরোনো সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান তৈরির পক্ষে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে।
তবে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সংবিধান বাতিল করার পরিবর্তে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিচ্ছে। বিশেষ করে, বিএনপির ৩১ দফায় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করে বিদ্যমান সাংবিধানিক সংকট নিরসনের পথে হাঁটতে চাচ্ছে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনায়ন করার মতো বিষয়গুলো সংবিধানে অর্ন্তভূক্ত করার বিষয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে।
বাহাত্তরের সংবিধানের বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয়সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান ৩১ দফায় তুলে ধরা হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, বিএনপির সংস্কার ভাবনা বাংলাদেশের বিদ্যমান সাংবিধানিক জটিলতা দূর করে, না নতুন জটিলতার সূত্রপাত ঘটিয়ে জাতীয় জীবনে নতুন আরেক সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে! নিশ্চয়ই বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহল কামাল হোসেন কমিশনের ব্যর্থতাগুলো বিবেচনায় রাখবেন। সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান সম্পন্ন যোগ্য ও দক্ষ লোকদের দিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করে সংবিধানের মারপ্যাঁচ থেকে জাতিকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার পথ তৈরি করে দিবেন।
পরিশেষে বলা যায়, সাংবিধানিক মারপ্যাঁচ থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনের ভেতরকার প্যাঁচের জট খুলতে হবে সর্বাগ্রে। একটা যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠন করার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। তাহলেই দেশ চলবে কাঙ্খিত পথে এবং পুরো জাতি পাবে সমৃদ্ধির পথে চলার সঠিক দিক নির্দেশনা। সুশিক্ষিত ও মননশীল জাতির বিবেকবোধই হলো সবচেয়ে কার্যকরী সংবিধান।
লেখক: তথ্যবিদ ও গবেষক