সম্প্রতি ঈদুল আজহা উপলক্ষে টানা ১০ দিনের ছুটি ঘোষণাকে ঘিরে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা দেখা গেছে। কেউ কেউ এ ছুটিকে তুলনা করেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দীর্ঘ ছুটির সঙ্গে, যা আমার কাছে একান্তই অপ্রাসঙ্গিক ও যুক্তিহীন মনে হয়েছে।
শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর, জ্ঞানের ফেরিওয়ালা। ত্যাগ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষকে ভালোবেসে অকৃপণভাবে মেধা ও পরিশ্রম কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারেন শিক্ষক। প্রতিটি মানুষ প্রথমে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করে। এরপর কেউ হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার কিংবা বিভিন্ন পেশাজীবী। কিন্তু তার প্রথম হাতেখড়ি হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
এই দীর্ঘ ছুটির সমালোচনা করতে গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নেতিবাচকভাবে টেনে আনা কেন—তা বোধগম্য নয়। অনেকেই এমনভাবে কথা বলেন যেন সব দোষ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এর শিক্ষকদের! বিষয়টি অত্যন্ত আপত্তিকর।
আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোও কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান—বেসরকারি নয়। সেগুলো ১০ দিন বন্ধ থাকলেও আপনার দৃষ্টিতে তা সমস্যা নয়; অথচ একই সময়ের ছুটি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হলে তাতে আপত্তি! লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এ সময় পাঠদান ও জ্ঞানচর্চা থেকে বিরত থাকে—আপনার মতে যদি এতে দেশের ক্ষতি না হয়, তাহলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আপনার চিন্তাভাবনার মধ্যেই এর উত্তর নিহিত আছে—একটু গভীরভাবে ভাবুন, তারপর জনসমক্ষে প্রশ্ন তুলুন। ইচ্ছেমতো একটি কলাম লিখে ফেলাই যুক্তির পরিচায়ক নয়।
সবার আগে মানুষের জীবন। ঈদে বাড়ি ফেরার পথে অনেক মানুষ প্রাণ হারায় সড়ক দুর্ঘটনায়। দুই কোটিরও বেশি মানুষ যখন তিন দিনের মধ্যে ঢাকা ছাড়ে ও ফিরে আসে, তখন একদিকে ভয়াবহ যানজট, অন্যদিকে জীবনহানির ঝুঁকি বাড়ে। তাই এই ঝুঁকি কমাতে ছুটি বাড়ানো হয়েছে।
আপনি বলেছেন, বিশ্বের কোনো দেশে এমন ছুটি দেওয়া হয় না। কথাটি সত্য হতে পারে, কিন্তু আপনি কি বাংলাদেশের সঙ্গে সব দেশের তুলনা করতে পারেন?
১। বাংলাদেশের মতো সর্বাধিক জনঘনত্বের দেশ আর আছে কি?
২। রাস্তায় বিশৃঙ্খলা এদেশের মতো আর কোথাও আছে?
৩। জনসংখ্যার তুলনায় রাস্তার ঘাটতি?
৪। ঈদে আমাদের দেশের মতো আবেগপ্রবণতা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায়?
৫। প্রতিদিন রাস্তায় মিটিং-মিছিল আর অবরোধ?
এসব সমস্যাগুলো—বিশেষত সড়কের অনিয়ম—বাংলাদেশের জন্য একপ্রকার ‘ক্যান্সার’। তা যদি দূর করা যেত, তাহলে তিন দিনের ছুটিই যথেষ্ট হতো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ১০ দিনের ছুটি যুক্তিযুক্ত।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিরত নয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত অধিকাংশ মানুষ ছুটি কাটান না। পরিবহন, হোটেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে। ব্যাংকিং কার্ড, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসও চালু থাকে। ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না।
প্রশ্ন ১: সরকার কি নিজ দায়িত্বে ছুটি নিতে পারে?
উত্তর: রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ছুটির মধ্যেও সচল থাকে। অতএব সরকার ছুটি নিতে পারে।
প্রশ্ন ২: সরকারি কর্মচারীরা যদি প্রাপ্য ছুটির সঙ্গে ঐচ্ছিক ছুটি যোগ করে দীর্ঘ ছুটি নেয়, তাহলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না কি?
উত্তর: কর্মচারীরা বিধি অনুযায়ী ছুটি নিতে পারেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান তা সমন্বয় করতে পারেন।
প্রশ্ন ৩: ছুটির কারণে খাদ্যসংকটে থাকা জনগণের ঝুঁকি বাড়বে না?
উত্তর: ছুটির মধ্যেও পরিবহন, বাজার ও ব্যবসা খোলা থাকে। ফলে খাদ্যসংকট হওয়ার আশঙ্কা অমূলক।
প্রশ্ন ৪: জনজীবনে বিশৃঙ্খলা বাড়বে—এ বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় নেই?
উত্তর: আসলে সরকারের বিবেচনায় ছিল বলেই ছুটি বাড়ানো হয়েছে যাতে সবাই একযোগে না বের হয়। এতে যানজট ও দুর্ঘটনা উভয়ই কমে।
প্রশ্ন ৫: একটি ধর্মীয় উৎসবে ১০ দিনের ছুটি দিলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবেও কি একই ছুটি দিতে হবে?
উত্তর: সরকার সকল ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সংবেদনশীল। যেমন—১৩ এপ্রিল পার্বত্য জেলায় বৌদ্ধদের জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
প্রশ্ন ৬: স্বাস্থ্যখাত, আদালত, প্রশাসন দীর্ঘ ছুটিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে না?
উত্তর: জরুরি স্বাস্থ্যসেবা চালু থাকে। আদালত ও প্রশাসন বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরি কাজ চালাতে পারে। বর্তমানে ডিজিটাল লেনদেন সহজ হওয়ায় অধিকাংশ সেবা সচল থাকে।
ঈদের টানা ১০ দিনের ছুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করা অপ্রাসঙ্গিক ও যুক্তিহীন। সমালোচনা অবশ্যই থাকবে, তবে তা হতে হবে গঠনমূলক। আমার মতে, বর্তমান সরকারের এই ছুটির সিদ্ধান্ত জনগণের চাহিদা ও বাস্তবতা অনুযায়ী যথার্থ। ঈদের আনন্দ, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটানো এবং সামাজিক কৃষ্টি রক্ষায় এ ছুটি প্রয়োজন। অন্যান্য দেশের উদাহরণ দিলে দেখা যাবে—চীন, জাপানেও বছরে একাধিকবার দীর্ঘ ছুটি দেওয়া হয়। এতে মানুষের মানসিক স্বস্তি বাড়ে এবং ছুটি শেষে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা দেশের উন্নয়নে সহায়ক।
লেখক: আবু রায়হান মো. ফিরোজ কবির, ব্যাংকার।