হজ্জ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, বাসনা, সংকল্প, দৃঢ় সংকল্প ও কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করা।ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় হজ্জ অর্থ, আল্লাহর ঘর যিয়ারতের লক্ষ্যে সফর করা এবং ব্যাপক অথের্ পবিত্র জ্বিলহজ্জ চাঁদের ৮ তারিখ হতে ১৩ তারিখের মধ্যে নির্ধারিত নিয়মে সুনির্দিষ্ট স্থানে তাওয়াফ যিয়ারত সাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি ও কঙ্কর নিক্ষেপসহ শরীয়ত নির্ধারিত কতিপয় অনুষ্ঠান পালন করাকেই হজ্জ বলে।
মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে হজ্জের ঘোষণা দিয়ে বলেন যে লোকের সামর্থ আছে তার উপর এ ঘরের হজ্জ করা হলো মানুষের উপর মহান আল্লাহর প্রাপ্য (সুরা ইমরান : ৯৭)। ইসলাম যে পাঁচটি বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে অন্যতম হল হজ্জ। যা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সম্মিলন। পৃথিবীর মধ্যে এর চেয়ে বড় সম্মেলন কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না। যা প্রতিবছর হজ্জকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। এ সম্মেলনের জন্য কাউকে কোন দাওয়াতনামা বা চিঠি কোনোভাবেই আহ্বান করতে হয় না। বরং মহান আল্লাহর আহ্বানে সবাই সমবেত হয় কাবার প্রাঙ্গনে, আরাফাতের প্রান্তরে, মিনার তাবুতে আর মুযদালিফার খোলা আকাশের নিচে। মহান আল্লাহর ঘোষণা মানুষের মধ্যে হজ্জের জন্য ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর দূরান্ত থেকে (সূরা আল হজ্জ : ২৭)।
আর তারই আহ্বানে বিশ্ব মুসলমানরা “আমি হাজির হে আল্লাহ, আমি উপস্থিত আমি হাজির, আপনার কোনো শরীক নেই। আমি হাজির, নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা ও নেয়ামতরাজি ও রাজত্ব আপনারই। আপনার কোনো শরীক নেই” এই ঘোষণা দিতে দিতে উপস্থিত হয়ে যান রবের ডাকে সাড়া দিতে আরবের ঐ মরু প্রান্তরে, কাবার ধারে, আরাফার সর্ববৃহৎ সম্মিলনে। হজ প্রবর্তনের আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) মহান আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ.) কে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, কাবাঘরটি হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন। হজরত ইবরাহিম জিবরাইল (আ.) এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ হজরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইবরাহিম (আ.) এর প্রতি নির্দেশ হলো হজব্রত পালনের। আল্লাহ তায়ালা হজরত জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে তাঁকে হজের সব আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেন। ইবরাহিম (আ.) তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) কে নিয়ে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেন এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজের সব আহকাম। এরপর মহান আল্লাহর নির্দেশ এলো হজের দাওয়াত বিশ্ববাসীকে পৌঁছে দেওয়ার। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন হজরত ইবরাহিম (আ.) কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেওয়া হয় তখন তিনি মহান আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কীভাবে পৌঁছবে? মহান আল্লাহ বললেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেওয়া।
সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। এ কথা শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) তখন মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। মহান আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন। এভাবে মক্কা পরিণত হলো হজব্রত পালনের ক্ষেত্রস্থল হিসেবে। সামাজিক সম্প্রীতি ও বিশ্বভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের গুরুত্ব সর্বাধিক। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য-সংহতি গড়তেও হজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব মুসলিমের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনাও লাভ করা যায় হজের বিশ্ব মহাসম্মিলন থেকে। পবিত্র কুরআন হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম গৃহ যা মানব জাতির জন্য নির্মিত হয়েছে। সে গৃহটি মক্কায় অবস্থিত, যা সমগ্র সৃষ্টিজগতের হিদায়েতের কেন্দ্র স্থান। তার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শন মাকামে ইব্রাহীম। যে কেউ তাতে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর হক্ব এই যে, এ ঘর পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ যাদের আছে তারা অবশ্যই হজ্জ আদায় করার জন্য এখানে আসবে (আল ইমরান-৯৬, ৯৭)। আর স্মরণ কর সেই ইতিহাসকে যখন আমি এ ঘরকে মানব সভ্যতার কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়স্থান বানিয়েছিলাম এবং মাকামে ইব্রাহীমকে মুসাল্লা’ বানাবার নির্দেশ দিয়েছিলাম আর ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে এ ঘরের তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু, সিজদাহকারীদের জন্য পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখার হুকুম দিয়েছিলাম। (আর স্মরণ কর সেই সময়ের কথা) যখন কা’বাগৃহ নির্মাণকার্য সমাপ্তির পর ইব্রাহীম (আ.) বলেছিলেন, হে আমার রব! তুমি এ নগরকে নিরাপদ জনপদে পরিণত করো। আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী তাদের জন্য বিচিত্র ফলমূল দিয়ে জীবিকা নির্বাহেরসংস্থান কর’ (আল-বাকারাহ : ১২৫-১২৬)। মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হজের বিনিময় নিশ্চিত জান্নাত। এ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।হজ শুধুই ইবাদত নয়।
হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ পবিত্র মক্কা নগরীতে একত্র হয়। ভাষা-বর্ণের ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক-জাতীয় পরিচয়ের পার্থক্য ও ভৌগোলিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব মুসলিমের ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত ও সুসংহত হয় পবিত্র হজ উদযাপনে। বিশ্ব মুসলিমের পারস্পরিক দুঃখ-অভাব, অভিযোগ-সমস্যা সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তার সমাধানের সুযোগ হয় পবিত্র হজের বিশ্ব সম্মিলনে। এ সম্মিলনে বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলিম অংশগ্রহণ করতে পারেন। হজের সম্মিলনে বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলিমের অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত। উঁচু-নিচু, ভাষা-বর্ণ, জাতি-গোত্র নির্বিশেষে বিশ্বের সামর্থ্যবান যেকোনো মুসলিমের নিঃশর্তভাবে হজ করার অধিকার ইসলামসম্মত।
হজ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঐক্যসম্মিলন, অন্য কোনো কারণে এত অধিক সংখ্যক মুসলমান কখনও একত্রিত হয় না। হজ কেবল ঈমানকে বলিষ্ঠ করে না, বরং এটা সমগ্র মুসলিম জাহানকে ঐক্যবদ্ধ করার পন্থা হিসেবেও কাজ করে। হজের সময় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মিল, দৃষ্টিভঙ্গির মিল এই প্রত্যেকটি জিনিসই মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ উন্নয়নে সাহায্য করে। বিশ্বের সব এলাকার, সব বর্ণের, সব ভাষার এবং প্রশিক্ষণ ভৌগোলিক জ্ঞানের সীমা সম্প্রসারিত করে জাতীয়তার প্রাচীরকে করে নিশ্চিহ্ন, সৃষ্টি করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এ নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমারেখার বিভিন্নতা ভুলে এককেন্দ্রিক হওয়ার পথ খুঁজে পায়। এর মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের চিত্র ফুটে ওঠে। এটি মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী চেতনা সৃষ্টি করে। হজ্জের মহান অনুষ্ঠান মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব মানব ঐক্য ও অবিচ্ছেদ্য সংহতির এক মহান নিদর্শন। প্রিয়নবী (সা.) আরাফাতের ময়দানে বলেন, আরবের ওপর আযমের এবং আযমের ওপর আরবের কোন প্রাধান্য নেই। সব মানুষ একই আদমের সস্তান। হজ্জ দুনিয়ার সাদা কালো, জীর্ণশীর্ণ বিচিত্র ভাষা ও বিচিত্র বর্ণের লোকদের আরাফাতের ও কা’বার চারিপাশে তাওয়াফরত অবস্থায় একত্রিত করে, সম্প্রীতির, মৈত্রীর সৌভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও সুমহান শিক্ষা প্রদান করে। হজ্জের অন্যতম কাজ হলো আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ৯ই জিলহজ্জ আরাফার ময়দানে অবস্থান ব্যতীরেখে হজ্জ আদায় হবে না। তাওয়াফে জিয়ারতকে তাওয়াফে ইফাদা বা হজ্জের তাওয়াফ বলা হয়। ১০ই জিলহজ্জ পাথর নিক্ষেপের পর হতে তিন দিন পর্যন্ত এই তাওয়াফ আদায় করা যায়।
এছাড়া হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, হজ্জের ওয়াজিব কার্যাবলী পাঁচটি। মুযদালিফায় অবস্থান করা, সাফা ও মারওয়াতে সায়ী করা, জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করা, ইহরাম ভঙ্গ করার নিমিত্তে মাথা মুণ্ডানো বা চুল কাটা এবং বিদায়ী তাওয়াফ করা। এছাড়া হজ্জের মধ্যে অসংখ্য সুন্নত কার্যাবলী রয়েছে। মহান আল্লাহ পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষেরা একই সাথে একই কার্যাবলী আদায়ের মাধ্যমে যে নজীর স্থাপন করে তা ইতিহাসের পাতায় বিরল। ইসলাম ধর্ম যে ভ্রাতৃত্বের ধর্ম, মুসলমানরা যে পর¯পর ভাই ভাই তার উজ্জ্বল ও উৎকৃষ্ট নমুনা হল পবিত্র হজ্জ। অন্য ভাষাভাষীদের সাথেও ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে প্রত্যেকে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। আদান-প্রদান হয় ভালোবাসা, সৌহার্দ্য আর প্রীতির। যে ভাবের বিনিময় গড়ে তোলে ঐক্য, সম্প্রীতি। পবিত্র হজ্জকে ঘিরে মুসলমানদের মধ্যে যে ঐক্যের সেতু বন্ধন তৈরী হয় তার ফলাফল সূদুর প্রসারী। সাধারণ মুসলমানদের মত বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ, দেশ প্রধানগণ একত্রিত হন কাবার আঙ্গিনায়। গড়ে ওঠে মতবিনিময়ের পরিবেশ, আবহ সৃষ্টি হয় বিশ্ব মুসলমানদের সমস্যা ও সমাধান নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণের। আর তা শুধু পবিত্র হজ্জের কারণে সম্ভবপর হয়ে উঠে। মোটকথা, হজ্জের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত ইবাদাত আদায়ের পাশাপাশি মুসলমানদের সর্বাধিক উপস্থিতির মাধ্যমে আরাফাতের জনসমুদ্রে যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য আর ঐক্য তৈরী হয় তা বিশ্বের ইতিহাসে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে, থাকবে। মহান আল্লাহ যেন সকলকে হজ্জ আদায়ের তাওফীক দেন। আমিন ।
লেখকঃ মোঃ কামাল উদ্দিন, প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আতাকরা কলেজ, কুমিল্লা।