বহুমুখী ঝুঁকিতে অর্থনীতি

বহুমুখী ঝুঁকিতে অর্থনীতি

উচ্চ মূল্যস্ফিতী, নগদ টাকা ও ডলারের সঙ্কট। ডলারের অভাবে জ¦ালানি তেল আমদানির ব্যয় মেটানোর সামর্থ্যরে অভাব। জনজীবন এবং শিল্প-কারখানা সচল রাখার জন্য চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস, কয়লা ও জ¦ালানি তেল আমদানির খরচ, বকেয়া বিল পাওনা মেটাতে নগদ টাকা ও ডলারের অভাব। নগদ টাকা ও ডলারের ঘাটতি বা সঙ্কট প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। আমদানি ও রফতানি প্রবাহ হ্রাসের ফলে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দরে নেই কন্টেইনার কিংবা কার্গোজট। জাহাজের জটও নেই। নেই আমদানি-রফতানিকারকদের ব্যস্ততা। যা আগের বছরগুলোতে ছিল দৃশ্যমান। তার ওপর ইতোমধ্যে তাপমাত্রার পারদ ৪০ ডিগ্রি সে. ছাড়িয়ে যাওয়ায় সারা দেশে উচ্চ তাপপ্রবাহ, টানা খরা-অনাবৃষ্টির বৈরী আবহাওয়ার কবলে হ্রাস পাচ্ছে মানুষের কর্মক্ষমতা। এর ফলে বোরো-ইরির আবাদ-উৎপাদন, আম-লিচুর ফলন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ ও প্রান্তিক পর্যায় থেকে শহর-নগর-শিল্পাঞ্চলে মানবসম্পদের গড় উৎপাদনশীলতা হ্রাস অথচ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তীব্র গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘন ঘন লোডশেডিং যন্ত্রণা। আর দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের মূল্য। এছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও সঙ্কটে ফেলছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশীয় সামষ্টিক অর্থনীতিতে চলমান সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাব আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে চলমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে শিপিং খরচসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়বে। এরফলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হলে তা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানি বিল বাড়ানোর দিকে ঠেলে দিতে পারে। সরকার বেশি দামে জ্বালানি আমদানিতে ব্যর্থ হলে লোডশেডিং ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়তে পারে। বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি নতুন করে উদ্বেগের মুখে পড়েছে। স্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন-ব্যবসার খরচ আরও বাড়বে। কারণ, এই উত্তেজনা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ নিলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম অনেক বেড়ে যেতে পারে। ফলে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের খরচ বেড়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। এছাড়া কারখানাগুলোতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলে আরও অনেক কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ দীর্ঘদিন থেকে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে এই সময়ে ব্যাপক উৎপাদনে যাওয়ার কথা শিল্প কারখানাগুলোর। অথচ ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে শিল্প কারখানা। গতকালও শ্রমিকদের না জানিয়েই ঈদের ছুটির মধ্যে কারখানা লে-অফের নোটিশ দিয়েছে গাজীপুরের বড়বাড়ী এলাকায় ন্যাশনাল কেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। ঈদের ছুটিতে শ্রমিকরা গ্রামের বাড়ি যান, ঈদ শেষে বাড়তি ভাড়া দিয়ে কর্মস্থলে ফিরে দেখেন কারখানা বন্ধের নোটিশ।
দেশে সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে সর্বস্তরে পুষ্টিহীনতা সমস্যা হচ্ছে প্রকটতর। কর্মসংস্থনের ক্ষেত্র ও সুযোগ-সম্ভাবনা অন্ধকারে নিমজ্জিত। বিশেষ করে শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও অর্ধ-দক্ষ কোটি যুবা-তরুণ বেকারত্বে হাবুডুবু খাচ্ছে। সরকার তথা প্রশাসনিক ব্যয়ের বোঝা ক্রমাগত বাড়লেও, সেই তুলনায় বাড়ছে না গড় উৎপাদনশীলতা তথা জনকল্যাণে অবদান, সেবাখাতের দক্ষতা। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা সীমিত আয়ের মানুষ। সমাজের টপ টু বটম সম্পদ ও আয়বৈষম্য ও ব্যবধান ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির প্রধান সূচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমতির দিকে। অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭ শতাংশের সর্বনিম্ন ধারায় চলছে। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে হয়েছিল ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। যদিও সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট ’ প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। একই সঙ্গে চলতি বছর মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে মূল্যস্ফীতি আগের মাসে কমার পর ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য ক্রমাগত ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করছে। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক আগেই দেশের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছাড়িয়েছে।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *