বাংলা নববর্ষ উদযাপন ও কিছু কথা।

বাংলা নববর্ষ উদযাপন ও কিছু কথা।

ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দ আজ না থাকলেও ডিজিটাল ঘড়িতে প্রতি মুহূর্তে ভেসে আসছে সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা। বহতা নদীর মতো বয়ে চলছে সময়, কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। গতকাল গত হলো ১ বৈশাখ ১৪৩০। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি বহমান প্রাচীন ধারা। বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালির প্রাণের উৎসব আয়োজন যেন এক সূত্রে বাধা। ইতিহাস থেকে জানা যায় ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবি বছর হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী তারা কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কৃষি ফলনের সঙ্গে এর কোনো মিল পাওয়া যেত না।
আর তখনই সম্রাট আকবরের সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপুঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফয়েজ উল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও আরবি হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরির কাজ শুরু করেন। বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৫৮৪ খ্রি. ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এই গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর করা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর। অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে। এভাবে বাংলা সনের জন্ম লাভ ঘটে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ৯৬৩ হিজরির বাংলা বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকায় তার সঙ্গে মিল রেখে ৯৬৩ বঙ্গাব্দের সূচনা করা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন : বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহণী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মষা থেকে মাষ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
প্রাচীন আরবে ‘ওকাজ মেলা’ ইরানিদের ‘নওরোজ উৎসব’ এবং প্রাচীন ভারতীয়দের ‘দোল পূর্ণিমা’, কোরিয়ানদের ‘সোল-নাল’ আর সমস্ত বাঙালিদের ‘পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ’ (সামাজিক উৎসব) সবার অন্তরে অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দে মাতোয়ারা করে সবাইকে একাকার করে দেয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন জনে বিজাতীয় ও হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে বাংলা নববর্ষকে বয়কট করার জন্য মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। এর প্রভাবে এ বছরও সামাজিক গণমাধ্যমে বিজাতীয় সংস্কৃতি, হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে বাংলা নববর্ষকে বয়কট করার আহ্বানও জানিয়েছেন কেউ কেউ। প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই কি নববর্ষ হারাম? বিজাতীয়, হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি? সবার আগে এ প্রসঙ্গটি পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন।
 বাংলা নববর্ষ চালু হয়েছে মোঘল সম্রাট আকবরের সময়। সম্রাট আকবর কতোটুকু মুসলিম ছিলেন সে বিতর্কে না গিয়ে মোঘল শাসনামল যেহেতু মুসলিম মুসলিম শাসনামল হিসাবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত তাই এ কথা বলা যায় যে, বাংলা নববর্ষের প্রচলন করেছে মুসলমান শাসকগণ।
 নববর্ষ হারাম না হালাল তা নির্ধারিত হবে নববর্ষ কীভাবে উদযাপন করা হচ্ছে তার বিচারের উপর। যেমন, যে কাজ ৩৬৫ দিন হারাম, তা নববর্ষে করাও হারাম। যে কাজ অন্য যেকোনো সময় করা হালাল, তা নববর্ষে করাও হালাল। প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ আঙ্গিকে নববর্ষ উৎযাপন করে। নববর্ষ উদযাপনে পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে- এটা কি হারাম?(অবশ্য ক্রোড়পত্রে হারাম কোনো অনুষঙ্গ থাকলে তা এমনিতেই হারাম)। বিভিন্ন কোম্পানী নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ মূল্য ছাড় দেয়- এটা কি হারাম? আবার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নববর্ষ উপলক্ষে যদি ককটেল বা ডিজে পার্টি দেয় তা কি বছরের বাকি দিনগুলোতে হালাল? নববর্ষ উপলক্ষে রমনার বটমূলে দেবদেবীর প্রশস্তিমূলক মাঙ্গলিক গান, বেদ-পুরাণের চরিত্রের অনুকরণে মুখোশ ও সাজসজ্জা পরিধান, উল্কি আঁকা, রমনা এলাকায় নারী-পুরুষের প্রচণ্ড ভিড়ে অবাধ মেলামেশা কি মুসলমানদের জন্য বছরের বাকি ৩৬৫ দিন জায়েজ? একাজগুলো অন্যান্য জাতীয় দিবসে হালাল
 বিজাতীয় সংস্কৃতির সংজ্ঞা নির্ধারণের আগে বাংলাদেশের জাতীয়তার সংজ্ঞা স্মরণ করা জরুরী। বাংলাদেশে প্রায় ১২ ভাগ অমুসলিম বাস করেন যাদের অধিকাংশ হিন্দু। তারাও আমাদের জাতির অভিন্ন অংশ। বাংলাদেশে বসবাসকারী জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষের সংস্কৃতিই বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি। কোনো হিন্দু যদি নববর্ষে দেবদেবীর প্রশস্তিমূলক মাঙ্গলিক গান বা শ্যামা সঙ্গীত গায়, বেদ পুরাণের চরিত্রের অনুকরণে মুখোশ ও সাজসজ্জা পরিধান করে এটাকে কি বিজাতীয় সংস্কৃতি বলা যাবে? পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বাসিন্দারা নববর্ষ উদযাপনে স্থানীয়ভাবে তৈরী মদ(বাংলা মদ) পান করে থাকে। নদীতে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা করে যা তাদের সংস্কৃতির অংশ- এটাকে কি বিজাতীয় বলা যায়? হোলি খেলা, চৈত্র সংক্রান্তি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব। এটাও বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি। কিন্তু বাংলাদেশী মুসলমানদের সংস্কৃতি নয়। কুরবানী যেমন হিন্দুদের সংস্কৃতি নয়, তেমনি বলি মুসলিমদের সংস্কৃতি নয়। কিন্তু দুটোই আবার একসাথে বাংলাদেশী জাতীয় সংস্কৃতি।
 যারা বাংলা নববর্ষ পালনকে না জাযেজ মনে করেন তাদের অনেকে আবার হালাল মনে করে ১ মহররমকে হিজরী নববর্ষ হিসাবে পালন করে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, হিজরী নববর্ষের সাথে ইসলামের সম্পর্ক কী? কুরআন হাদীসে কি হিজরী নববর্ষের কথা বলা হয়েছে? হিজরী সন তো শুরু হয়েছে রসুলের(সা.) ওফাতের অনেক বছর পর হযরত ওমর(রা.) শাসনামলে, ইরাক ও কুফার প্রশাসক আবু মুসা আশআরী (রা.) প্রস্তাবে শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে। হযরত ওমর (রা.)এটা উদযাপন করেননি।কিন্তু এখন আরবরা সাড়ম্বরে হিজরী নববর্ষ সাড়ম্বরে পালন করে থাকে।
 আসলে বাঙালী মুসলমানের সংস্কৃতি কি হবে হাজার বছর ধরে এদেশের আলেম সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মী ও মুসলিম বৃদ্ধিজীবীরা নির্ধারণ করেননি। শুধু না জায়েজ, হারাম বলে প্রচার করেছেন, ফতোয়া দিয়েছেন। আর এই সুযোগে একটি গ্রুপ আরব সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি বলে বাঙালী মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আরব সংস্কৃতি ও ইসলামি সংস্কৃতি এক নয়। আরবরা আবহাওয়া ও ভূ-প্রাকৃতিক কারণে উটে চড়ে, রুমাল ও জোব্বা পরিধান করে, মশকে(চামড়ার পাত্রে) পানি খায়। তাই বলে এগুলো ইসলামিক সংস্কৃতি নয়।
 অপসংস্কৃতি, বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে আমরা শুধু চিৎকার করেছি, কিন্তু সংস্কৃতি কি তা নির্ধারণ করিনি। ফলে আমাদের তরুণরা না বুঝে, না জেনে, অসতর্ক ও অসচেতনভাবে অপসংস্কৃতির খপ্পরে পড়েছে। এ কথা ভুললে চলবে না যে, চিৎকার করে, ফতোয়া দিয়ে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করা সম্ভব নয়। সুষ্ঠু সংস্কৃতির জোরালো চর্চাই কেবল পারে অপসংস্কৃতির কবল থেকে তরুণ সমাজকে দুরে রাখতে।
বৈশাখের অনুষ্ঠানে রমনা এলাকায় আমি অনেক বোরখাপরা নারীকে দেখেছি, অনেক দাঁড়ি, টুপিওয়ালা তরুণকে দেখেছি। নববর্ষ পালনের ইসলাম সম্মত উপায় তাদের সামনে থাকলে হয়তো এদের অনেকেই এ অনুষ্ঠানে শরীক হতো না। ইসলামপন্থীদের প্রতি অনুরোধ বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানো ইসলাম সম্মত র্যােলি, উৎসবের আয়োজন করুন যাতে বাঙালি মুসলমানের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়। যা ইসলামী বিধি নিষেধে আটকায় না আবার মুসলিম সম্প্রদায় আনন্দ ও উৎসবে ঘাটতি না থাকে। তাহলেই কেবল শিরক থেকে বাঙালি মুসলিম তারুণ্যকে ফেরানো সম্ভব।
কাজেই আমাদের তরুণ সমাজকে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সুষ্ঠু সংস্কৃতি ও নির্মল বিনোদনের রূপরেখা তৈরী করে তার জোরালো চর্চা করতে হবে। মুসলিম সম্প্রদায় কিভাবে ইসলাম সম্মতভাবে নর্ববর্ষ উদযাপন করবে তার রূপরেখা মুসলিম ধর্মীয় স্কলার ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের বের করতে হবে। যুগোপযোগী চাহিদা পুরণের উপযোগী নববর্ষের আনন্দ, বিনোদন ও উৎসব উপভোগের ইসলাম সিদ্ধ পন্থা বের করা গেলে মুসলিম তরুণ-তরুণীদের সহজেই অপসংস্কৃতি থেকে দুরে রাখা সম্ভব।
লেখকঃ কলেজের অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *