বঙ্গবন্ধুর কৈশোর থেকে সূচিত রাজনৈতিক জ্ঞানের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনের বাঙালির অধিকার‘ আমাদের বাঁচার দাবি ৬দফা কর্মসূচি’ শিরোনামে পাকিস্তানে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।কিশোর বয়স থেকে বঙ্গবন্ধু মাটি-মানুষের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন।বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফার দীপ্ত আলোতে উদীপ্ত করেছিলেন পুরো জাতিকে।বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পরবর্তী সময়ে নিজেকে রাজনীতির শক্তভীত গড়ে তুলেছিলেন।পূর্বপাকিস্তানের শোষিত নিপীড়িত মানুষের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।১৯৫৫ সালের ৫জুন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।১৯৫৫ সালের ২৫আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদের সেশনে বলেছিলেন
‘Sir, you will see that they want to place the word ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal.’ We have demanded so many times that you should use Bengal instead of East Pakistan. The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own.’
“ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করত পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে।তাতে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার থাকিবে।সকল নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে।আইন সমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।”পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার এটি একটি দিক।
“ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষাও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুইটি বিষয় থাকিবে।অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেট সমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে।”
“এই দফায় আমি মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অল্টারনেটিভ প্রস্তাব দিয়াছি।এই দুটি প্রস্তাবের যেকোন ও একটি গ্রহণ করিলেই চলিবে:
(ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজেই বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে।
এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকিবেনা, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে।দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র‘স্টেট’ ব্যাংক থাকিবে।
(খ)দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে।এ ব্যবস্থায় এ মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে।কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্বপাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতেনা পারে।এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে; দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে।” “সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা-কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে।ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না।আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিক্যালিজমা হইয়া যাইবে।এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংক সমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে।এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।”
“এই দফায় আমি বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপারে নিন্মরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করিয়াছি :
১।দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে।
২।পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্বপাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক
মুদ্রা পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে।
৩।ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারা হারি মতে
আদায় হইবে।
৪।দেশ জাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি রফতানি চলিবে।
৫।ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রফতানি
করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে।”
“এই দফায় আমি পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বাপ্যারা মিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ করিয়াছি।এ দাবি অন্যায় ও নয়, নতুন ও নয়।একুশ দফার দাবিতে আমরা আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্রবাহিনীতে রূপান্তরিত করার দাবি করিয়াছিলাম।তাতো করা হয়ই নাই, বরঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ ই.পি.আর. বাহিনীকে এখন কেন্দ্রের অধীনে নেওয়া হইয়াছে।পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রকারখানা ওনৌ-বাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করতঃএ অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবি একুশ দফার দাবি।কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বারো বছরে ও আমাদের একটি দাবি ও পূরণ করেন নাই।পূর্বপাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানীর বাসস্থান।এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবি করিতে হইবে কেন? সরকার নিজে হইতে সে দায়িত্ব পালন করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তান আগে বাঁচাইয়া সময় ও সুযোগ থাকিলে পরে পূর্বপাকিস্তান বাঁচানো হইবে ইহাই কি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত?
পাকিস্তানেই রহিয়াছে এমন সাংঘাতিক কথা শাসন কর্তারা বলেন কোন মুখে? মাত্র সতেরো দিনের পাক-ভারত যুদ্ধই
কি প্রমাণ করে নাই আমরা কত নিরুপায়? শত্র æরদয়াওমর্জির উপর তো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারিনা।কেন্দ্রীয়
সরকারের দেশ রক্ষানীতি কার্যত আমাদেরকে তাই করিয়া রাখিয়াছে। তবু আমরা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির খাতিরে দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিতে চাই।সঙ্গে
সঙ্গে এ ও চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বপাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আত্মনির্ভর করিবার জন্য এখানে উপযুক্ত পরিমাণ
দেশ রক্ষাবাহিনী গঠন করুন।নৌ-বাহিনী অস্ত্রকারখানা স্থাপন করুন।নৌ-বাহিনীর দফতর এখানে নিয়া আসুন। এসব কাজ সরকার কবে করিবেন জানি না।কিন্তু ইতিমধ্যে অল্পখরচে ছোট খাটো অস্ত্রশস্ত্র দিয়া আধা সামরিক বাহিনী গঠন করিতে ও পশ্চিমা ভাইদের এত আপত্তি কেন? পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্রযুদ্ধ-তহবিলে চাঁদা উঠিলেতা ও কেন্দ্রীয় রক্ষা তহবিলে নিয়া হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার আমরা ও চাইনা।এ অবস্থায় পূর্বপাকিস্তান যেমন করিয়া পারে গরীবিহালে আত্মরক্ষা করিবে, এমন দাবি কি অন্যায়? এই দাবি করিলেই সেটা হইবে দেশ দ্রোহিতা? ”
বাঙালি জাতির পুরোস্বার্থ ছিল তাঁর চিন্তা-চেতনার বড় বঞ্চিত জনগণের ভেবেছিলেন।৬দফা একটি জাতির স্বাধীকার বোধের নিশ্চয়তা ছিল।২৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন,আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থন সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকার পরে দেশের সাধারণ নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অধিকার অর্জন করেছিলেন।কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে বঞ্চিত করে।৬ দফার পাঁচ বছর পরে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হন।
লেখকঃ মোঃ মাসুম বিল্লাহ,
সহকারী অধ্যাপক
কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ,
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ