মহান আল্লাহ মুসলিম জাতিকে এমন কিছু বরকতময় দিন ও রাত দিয়েছেন, যাতে ইবাদত করলে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। এসবের মধ্যে শবে বরাত একটি। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘লাইলাতুন মিন নিসফি শাবান’ বলা হয়। মুসলিম উম্মাহর কাছে এ রাত শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত হিসেবে পরিচিত। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘এ রাতের ফজিলত ও মর্যাদা অনেক বেশি।
এ রাতের গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রয়েছে, হযরত আয়শা (রাযি.) বর্ণনা করেন যে, এক রাতে আল্লাহর রাসুল আমার ঘরে থাকার পালা ছিল, রাতে তিনি আমার সাথে আমার ঘরে শুয়েছেন। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমি আশেপাশে অনেক খুঁজে দেখলাম যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বিছানায় নেই। আমি সন্দেহ করলাম, কী ব্যাপার, আল্লাহর রাসুল কি আজকে আমাকে ছেড়ে অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে চলে গেলেন? আজকের রাততো আমার হক। হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন যে, আজ রাত্রে তো আল্লাহর রাসুল আমার ঘরে থাকার কথা, তিনি কোথায়? রাসুল (সা)কে খোঁজার জন্য তিনি বের হয়ে গেলেন, বের হয়ে দেখলেন মসজিদে নববীর পাশে জান্নাতুল বাকী কবরস্থান, (যেখানে অসংখ্য সাহাবার কবর আছে) সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি যিয়ারত করছেন। আল্লাহর রাসুল যখন টের পেয়ে গেলেন যে, হযরত আয়শা (রাযি.) এসেছেন তখন তিনি হযরত আয়শার সাথে কথা বললেন, জিজ্ঞেস করলেন-হে আয়েশা: তোমার কি এ মর্মে আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর এবং তার রাসুল তোমার ওপর জুলুম করবেন? তোমার প্রাপ্য হক তিনি নষ্ট করবেন? তুমি কি ভয় করছো? জেনে রাখ আল্লাহ এবং তার রাসুল কারো হক নষ্ট করতে পারে না। কোন মানুষের ওপর জুলুম করতে পারে না। বান্দার হককে নষ্ট করতে পারে না। কিন্তু হে আয়েশা, জেনে রাখ, আজকের রাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথম আসমানে অবতরণ করেন, সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেই। অর্থাৎ মাগরিব থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রহমত নিয়ে বান্দাদেরকে রহমত দান করার জন্য প্রথম আসমানে আসেন।
ফয়জুল কাদির গ্রন্থে এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রহমতের দৃষ্টি বান্দাদের প্রতি নিবদ্ধ করার জন্য তাঁর রহমত তিনি প্রেরণ করেন। হে আয়েশা! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দয়া নিয়ে আজকের এ রাতে প্রথম আসমানে নাজিল হন এবং প্রচুর সংখ্যক মানুষের গোনাহকে তিনি ক্ষমা করেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের গোনাহকে তিনি মাফ করেন। হে আয়েশা, এজন্যেই আমি যারা কবরের মধ্যে শুয়ে আছে তাদের যিয়ারত করতে গেলাম। তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। তাদেরকে দেখার জন্য আজকে পবিত্র রাতে আমি এসেছি। তোমার প্রতি জুলুম করে অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে আমি যাইনি। এ হাদিস ইমাম তিরমিযী (রহ.) বর্ণনা করেছেন। এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, এ রাত হচ্ছে তাওবার রাত, এ রাত হচ্ছে আল্লাহর কাছে পাওয়ার রাত, চাওয়ার রাত। এ রাত হচ্ছে আল্লাহর দরবারে কাঁদার রাত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গোনাহ মাফ করার জন্য প্রস্তুত। আমাকে মাফ চাইতে হবে।
এ রাতে দু’শ্রেণির লোককে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। প্রথম ব্যক্তি হল ‘মুশরিক’। তাকে আল্লাহ আজ রাতে রহমত দিয়ে আচ্ছাদিত করবেন না। আল্লাহর নামের সাথে শিরক করে, আল্লাহ ইবাদতে শিরক করে, আল্লাহ সিজদার মধ্যে শিরক করে এবং শিরকের যত প্রকার হতে পারে ছোট, বড়, প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য সব ধরনের শিরককারীকে মুশরিক বলা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আজকের রাত্রে তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। কাজেই অন্তর থেকে শিরক ও যাবতীয় কুসংস্কারকে দূর করতে হবে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি যার গোনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না, যার তাওবা কবুল করবেন না, তাকে রহমত করবেন না, যে আত্মীয়তার সম্পর্কছেদকারী। যাদের সাথে কোন ভাইয়ের সম্পর্ক, বোনের সম্পর্ক নেই, মা-বাবার সাথে খারাপ আচরণ করেছে, অন্যায় করেছে, ফুফুর সাথে সম্পর্ক নেই, খালার সাথে সম্পর্ক নেই, মামার সাথে সম্পর্ক নেই, রক্তের আত্মীয়-স্বজনের সাথে যাদের সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক নষ্ট করেছে, আজকের এ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের গোনাহকে মাফ করবেন না। তাদের দোয়া কবুল করবেন না। তাদেরকে রহমত করবেন না। কারো ভাইয়ের সাথে যদি সম্পর্ক নষ্ট থাকে, বোনের সাথে যদি সম্পর্ক নষ্ট থাকে, মা-বাবার সাথে যদি কখনো বেয়াদবি হয়ে থাকে, তাহলে এখনই ক্ষমা চেয়ে তার পর আল্লাহর রহমত চাইতে হবে, এর আগে যদি আল্লাহর রহমত চাওয়া হয় আল্লাহ রহমত করবেন না।
হাদিসে আছে, এ রাতে যারা মা-বাবার সাথে কোন বেয়াদবি করেছে মা-বাবার অন্তরে আঘাত দিয়েছে, কথায় কষ্ট দিয়েছে, কাজে কষ্ট দিয়েছে, সামর্থ্য থাক সত্ত্বেও মা-বাবার জন্য ব্যয় করেনি, মা-বাবার অসুস্থ থাকা অবস্থায় তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আজকের রাতে তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। যাদের মা-বাবা এখন দুনিয়াতে নেই, ক্ষমা চাওয়ার মত উপায় নেই তাদের পরিত্রাণের উপায় হল তাদের কবর যিয়ারত করা, তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে তাওবা এবং দোয়া করা।
আমরা এ রাতে ঘরে কিংবা মসজিদে নীরব জায়গায় আল্লাহ দরবারে কান্নার চেষ্টা করব। কারণ এ রাত হচ্ছে কান্নার রাত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষকে ক্ষমা করবেন। আর আমি যেন এ লক্ষ মানুষের বাইরে না থাকি। আল্লাহ রহমতের চাদরে যেন আমি অন্তর্ভুক্ত থাকি। চাদরের বাইরে যেন আমার স্থান না হয়। এ জন্য আল্লাহর দরবারে ফুঁপিয়ে কাঁদতে হবে। বুক ফেটে কাঁদতে হবে। যার চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্রু বের হবে একমাত্র আল্লাহকে রাজি করার জন্য, কাউকে দেখানোর জন্য নয়। হাদিসে আছে মশার ডানা পরিমাণ অর্থাৎ এক কণা চোখ দিয়ে যদি পানি বের হয়ে ঝরে পড়ে যায় তাহলে সে চোখকে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। অর্থাৎ সে লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবেন। আসুন আমরা কাঁদি আল্লাহর দরবারে কাঁদি, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও, তুমি যদি মাফ না কর তাহলে মাফের কোন উপায় নেই। হে আল্লাহ তুমি মাবুদ, তুমি রহমান, তুমি রহীম, আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও। এভাবে বলব আর কাঁদবো। আল্লাহর কাছে চাইব, নিজেকে ছোট করব, তাওবা করব।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বার বার বলেন, হে বান্দা তাওবা কর, ক্ষমা চাও, মাফ চাও, দুনিয়ার মানুষ মাফ চাইলে মাফ করতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ পাক বলেন, আমি মাফ করে দিতে প্রস্তুত। আমি রাহমানুর রাহীম।
এ রাতে সাধ্যমতো নফল নামাজ আদায় করা এবং পরের দিন নফল রোজা রাখা খুবই পুণ্যের কাজ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত আসবে, তখন তোমরা দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে এবং দিনে রোজা রাখবে।’ (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৮) শবে বরাতে বেশি বেশি নফল নামাজ আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) এ রাতে ১০০ রাকাত নফল নামাজ আদায়ের উপদেশ দিয়েছেন।
বৎসরের প্রতি রাতেই তো আমরা ঘুমাচ্ছি। অন্তত কয়েকটি রাত, শা’বানের মধ্যরাত, কদরের রাত এবং দু’ঈদের রাত জাগ্রত থেকে পূর্ণরাত ইবাদত করে আল্লাহর দরবারে যদি কাটিয়ে দিই তাহলে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। কাজেই পুরা রাত আমরা ইবাদত করার চেষ্টা করব। নামায পড়বো, এরপর সুন্দরভাবে শুদ্ধ করে কুরআন তেলাওয়াত করার চেষ্টা করবো। এরপর বেশি করে আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ শরিফ পাঠ করব। একবার যে ব্যক্তি আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ পাঠ করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ওপর দশটি রহমত নাজিল করবেন। যে দোয়ার শুরুতে আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ পড়া হয় না আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা কবুল করেন না। এজন্য দোয়ার শুরুতেও দুরুদ পাঠ করতে হবে এবং শেষেও দুরুদ পাঠ করতে হবে। এরপর আমরা ‘ইস্তেগফার’ করব হে আল্লাহ অনেক গোনাহ করেছি, সে গোনাহ থেকে আমরা ক্ষমা চাই এটাকে বলা হয় ‘ইস্তেগফার’। বার বার করতে থাকব। কারণ এটা তাওবার রাত, গোনাহ মাফ চাওয়ার রাত। এ জন্য দুরুদ এবং ইস্তেগফার বেশি বেশি আদায় করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন!
লেখকঃ মোঃ কামাল উদ্দিন, প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আতাকরা কলেজ, কুমিল্লা।