বিপদাপদ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম

বিপদাপদ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম

দুনিয়ার জীবন আল্লাহ বানিয়েছেন আখেরাতের জন্য। আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাসের জন্য আল্লাহ দুনিয়ার জীবন বানাননি। তাই দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ কাউকে শুধু সুখ আর সুখ দেননি। এখানে যে সবচেয়ে সুখী তাকেও মাঝেমধ্যে দুঃখ পেতে হয়; যে সবচেয়ে সুস্থ তাকেও কখনো কখনো অসুস্থ হতে হয়। এখানে সুখের পাশে আছে দুঃখ, সুস্থতার পাশে আছে অসুস্থতা, হাসির সাথে মিশে আছে কান্না। তবে একজন মুমিনের জীবনের মাকসাদ যেহেতু আখেরাত, তাই তার দুনিয়ার জীবনের বিপদাপদ, রোগশোক, দুঃখ-দুর্দশা মোটেই নিরর্থক নয়। আল্লাহ চান, দুনিয়ার এ অল্প কয়েকদিনের কষ্টের বিনিময়ে বান্দা লাভ করুক আখেরাতের অফুরন্ত শান্তি। কুরআন বারবার এদিকেই মুমিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যখনই কোনো বিপদ আসে, কুরআন মুমিনকে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ভবিষ্যতের পরিবর্তে আখেরাতের চিরস্থায়ী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে বলে।
আমরা যারা বর্তমানের যান্ত্রিক যুগের মানুষ, যাদেরকে জীবনের নানা অঙ্গনে নিত্যদিনই হতাশা ও নৈরাশ্যের সম্মুখীন হতে হয়, আমাদের জন্য কুরআনের বিভিন্ন বাণী ও বার্তায় রয়েছে অনেক শিক্ষা ও হেদায়েত। এক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় হযরত ইয়াকুব আ.-এর ঘটনা। সেই বহু বছর আগে হারিয়েছেন নিজের প্রিয়তম পুত্র ইউসুফ আ.-কে। তাঁর বিয়োগ-ব্যথায় এবং তাঁকে পাওয়ার আশায় যৌবন কেটে গেল। বৃদ্ধকালে যখন ইউসুফ আ.-কে পাওয়ার আশায় আবার বুক বাঁধলেন তখন ইউসুফ আ.-এর অপর ভাইকেও হারালেন। বাধ্যর্ক্যজনিত দুর্বলতা, দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতা, নতুন করে সন্তান হারানোর ঘটনা যেন ইউসুফ আ.-কে হারানোর বেদনা পুনরায় জাগিয়ে দিল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি হাল ছাড়লেন না। আল্লাহর রহমতের প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস নিয়ে তিনি বললেন—

قَالَ اِنَّمَاۤ اَشْكُوْا بَثِّيْ وَ حُزْنِيْۤ اِلَي اللهِ وَ اَعْلَمُ مِنَ اللهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ، يٰبَنِيَّ اذْهَبُوْا فَتَحَسَّسُوْا مِنْ يُّوْسُفَ وَ اَخِيْهِ وَ لَا تَايْـَٔسُوْا مِنْ رَّوْحِ اللهِ اِنَّهٗ لَا يَايْـَٔسُ مِنْ رَّوْحِ اللهِ اِلَّا الْقَوْمُ الْكٰفِرُوْنَ.

আমি আমার দুঃখ ও বেদনার অভিযোগ (তোমাদের কাছে নয়) আল্লাহর কাছে করছি। আর আল্লাহ সম্পর্কে আমি যতটা জানি, তোমরা ততটা জান না। ওহে আমার পুত্রগণ, তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সন্ধান চালাও। তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। জেনে রেখ, আল্লাহর রহমত থেকে কেবল তারাই নিরাশ হয়, যারা কাফের। —সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৬-৮৭

এ ঘটনা থেকে বোঝা গেল, দুনিয়াবী কঠিন থেকে কঠিন বিপদেও আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হওয়া যাবে না; বিপদের পর বিপদের সম্মুখীন হলেও না। আল্লাহর রহমতের কাছে আশা রাখতে হবে, ইনশাআল্লাহ, সকল বিপদ কেটে যাবে। বিপদ যদি নাও কাটে, তবু চিন্তা কীসের, আল্লাহ তো এর বিনিময়ে আখেরাতে অনেক অনেক বেশি দেবেন। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে, এ বিপদটিকে আমি মনে করছি বিপদ, কিন্তু বাস্তবে সেটি আমার জন্য কল্যাণকর। দুনিয়ায় এমন কত কত ঘটনা রয়েছে, যেখানে আপত দৃশ্যমান বিপদ— পরিণামে কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে। সূরা বাকারায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন—

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَ هُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ وَ عَسٰۤي اَنْ تَكْرَهُوْا شَيْـئا وَّ هُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَ عَسٰۤي اَنْ تُحِبُّوْا شَيْـئا وَّ هُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَ اللهُ يَعْلَمُ وَ اَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ.

তোমাদের প্রতি (শত্রুর সাথে) যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে। এটা তো খুবই সম্ভব যে, তোমরা একটা জিনিসকে মন্দ মনে কর, অথচ তোমাদের পক্ষে তা মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর। আর এটাও সম্ভব যে, একটা জিনিসকে পছন্দ কর, অথচ বিষয়টি তোমাদের পক্ষে মন্দ ও অকল্যাণকর। আর (প্রকৃত বিষয় তো) আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। —সূরা বাকারা (২) : ২২৬

আয়াতটিতে দৈনন্দিন জীবনের হতাশাজনক পরিস্থিতিতে কী মনোভাব রাখতে হবে— এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। জীবন চলার পথে চিন্তা-চেতনায় এই আয়াতটিকে সামনে রাখলে আমাদের পার্থিব জীবনও বড় শান্তির হতে পারে।

হতাশা যদি আসে গোনাহের কারণে, ঈমান-আমল ও আখেরাতের প্রতি উদাসীনতার কারণে, তাহলেও হাতাশাকে মনে জায়গা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ তো অতি দয়ালু, পরম ক্ষমাশীল। তিনি তো সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—

قُلْ يٰعِبَادِيَ الَّذِيْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤي اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ اِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.

বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজ সত্তার ওপর সীমালঙ্ঘন করেছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। —সূরা যুমার (৩৯) : ৫৩

আরো কয়েকটি আয়াতের স্মরণ ও মোরাকাবা হতাশার সময় মনে সান্ত্বনার পরশ বুলাতে পারে। দুনিয়া পরিচালনায় আল্লাহর যে সুন্নত তথা অমোঘ বিধান রয়েছে সেসকল আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। আয়াতগুলো যদি স্মৃতিতে সদা জাগরূক রাখতে পারি তাহলে চরম হতাশার পরিস্থিতিতেও অন্তর নিশ্চিন্ত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

যখনই কোনো বিপদ আসে, মনে করতে হবে, এর সঙ্গে নিশ্চয় এর চেয়ে দ্বিগুণ স্বস্তি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—

فَاِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا، اِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا.

প্রকৃতপক্ষে কষ্টের সাথে স্বস্তিও থাকে। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তিও থাকে। —সূরা ইনশিরাহ (৯৪) : ৫-৬

স্বস্তি কখন আসবে, কীভাবে আসবে; কখন বিপদ দূর হবে, কীভাবে দূর হবে— এর জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না। আল্লাহর পক্ষ থেকে এর সময় ও ধরন নির্ধারিত আছে। আল্লাহ তাআলার নিকট বিশ্বজগতের প্রতিটি জিনিসের একটি মাপজোখ ঠিক করা আছে। সুখ যেমন চিরদিন থাকে না, তেমনি কোনো বিপদও চিরস্থায়ী হয় না। যতদিন আল্লাহ লিখে রেখেছেন ততদিন থাকবে। এবং কারো বুঝে আসুক বা না আসুক, মনে করতে হবে, এর মধ্যে অবশ্যই আমার জন্যে কোনো না কোনো কল্যাণ নিহিত আছে। যখন এভাবে নিজেকে আল্লাহর ফায়সালার সামনে সঁপে দেবে তখন অন্তরে আল্লাহ একধরনের প্রশান্তি ঢেলে দেবেন। নিচের আয়াতগুলোর সারমর্ম এমনই—

مَاۤ اَصَابَ مِنْ مُّصِيْبَةٍ فِي الْاَرْضِ وَ لَا فِيْۤ اَنْفُسِكُمْ اِلَّا فِيْ كِتٰبٍ مِّنْ قَبْلِ اَنْ نَّبْرَاَهَا اِنَّ ذٰلِكَ عَلَي اللهِ يَسِيْرٌ، لِّكَيْلَا تَاْسَوْا عَلٰي مَا فَاتَكُمْ وَ لَا تَفْرَحُوْا بِمَاۤ اٰتٰىكُمْ وَ اللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرِ.

পৃথিবীতে অথবা তোমাদের প্রাণের ওপর যে মুসিবত দেখা দেয় তার মধ্যে এমন কোনোটিই নেই, যা সেই সময় থেকে এক কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই, যখন আমি সেই প্রাণসমূহ সৃষ্টিও করিনি। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ। তা এ জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ, তার জন্য যাতে দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না, যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে। —সূরা হাদীদ (৫৭) : ২২-২৩

مَاۤ اَصَابَ مِنْ مُّصِيْبَةٍ اِلَّا بِاِذْنِ اللهِ وَ مَنْ يُّؤْمِنْۢ بِاللهِ يَهْدِ قَلْبَهٗ وَ اللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ.

কোনো মুসিবতই আল্লাহর হুকুম ছাড়া আসে না। যে-কেউ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে হেদায়েত দান করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞাত। —সূরা তাগাবুন (৬৪) : ১১

وَ مَنْ يَّتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا، وَّ يَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَ مَنْ يَّتَوَكَّلْ عَلَي اللهِ فَهُوَ حَسْبُهٗ اِنَّ اللهَ بَالِغُ اَمْرِهٖ قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا.

যে কেউ আল্লাহ্কে ভয় করে চলবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। যে-কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ্ই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কাজ পূরণ করেই থাকেন। (অবশ্য) আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। —সূরা তালাক (৬৫) : ৩

যদি আমরা এ আয়াতগুলো সামনে রাখি এবং যে কোনো হতাশায় নিজের শিক্ষক, মুরব্বী, মা-বাবা, ভাইবোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাহচর্য অবলম্বন করি, তাঁদের সাথে নিজেদের মনের দুঃখকষ্ট ভাগাভাগি করি, সবোর্পরি নির্জনে হাত তুলে আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলি, তাহলে এই হতাশাই হতে পারে আমাদের জীবনে আশার আলো। বিপদাপদ হতে পারে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।
লেখকঃ মোঃ কামাল উদ্দিন, প্রভাষক,ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,আতাকরা কলেজ,কুমিল্লা।।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *