রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা শুধু তাজীমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা শুধু তাজীমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়

বড়কে সম্মান করা একটি স্বতঃসিদ্ধ এবং সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। ইসলামও বড়দের সম্মান করার এবং আলেমদের শ্রদ্ধা করতে গুরুত্বের সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছে। তাহলে রাসূলুল্লাহ (সা.), যাঁকে আল্লাহ সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মাকাম দান করেছেন দুনিয়াতে এবং আখিরাতে, আর যাঁকে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামসহ সকল বনী আদমের সাইয়েদ ও সরতাজ বানিয়েছেন, রাব্বুল আলামীনের পর জগৎবাসীর ওপর যাঁর অনুগ্রহই সর্বাধিক, স্বয়ং রাব্বুল আলামীন যাকে রাহমাতুল্লিল আলামীন ও খাতামুন নাবিয়ীন উপাধীতে ভূষিত করেছেন তাঁর তাজীম ও সম্মান যে গোটা মানবজাতির জন্য ফরজ ও অপরিহার্য হবে তা তো বলাই বাহুল্য।
এখানে যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সম্মান ও তাজীমের বিষয়কে আল্লাহ তায়ালা শুধু বড়দের সম্মান করার সাধারণ আদেশের মধ্যেই ছেড়ে দেননি; বরং তাঁর তাজীম-সম্মানের বিষয়ে বিশেষ বিশেষ বিধান নাজিল করেছেন। তাঁর আদব-ইহতেরাম আল্লাহ এমন অপরিহার্য করেছেন যে, এটা ছাড়া কারো ঈমান তাঁর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। এমন সকল কথা-কাজ, আচার-আচরণ আল্লাহ তায়ালা হারাম করেছেন এবং লানত ও অভিশাপের কারণ সাব্যস্ত করেছেন যা নবীকে কষ্ট দেয়।
আদব-ইহতিরামের যে বিষয়গুলোতে মানুষ কখনো অসচেতন হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে কুরআনি আয়াতে স্পষ্ট নির্দেশ দান করেছেন আর তা পালনে যতœবান হতে আদেশ করেছেন। আর সাবধান করে দিয়েছেন, এর অন্যথা হলে আশঙ্কা রয়েছে যে, সকল আমল বিনষ্ট হবে’। (সূরা আরাফ ১৫৭, সূরা ফাৎহ ৯, সূরা হুজরাত ১-৫, সূরা নূর ৬৩, সূরা আহযাব ৫৩, ৫৬-৫৮; সূরা তাওবা ৬১, সূরা বাক্বারা ১০৪, সূরা নিসা ৪৭)।
মহব্বত এবং তাজীমের বিষয়টি শুধু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহব্বত ও তাজীমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর সঙ্গে যাদের বিশেষ সম্পর্ক আর যে জিনিষগুলো তাঁর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত তাদের সঙ্গেও মুমিনের ভালোবাসার সম্পর্ক হওয়া জরুরি। প্রেম-ভালোবাসার ধর্ম হচ্ছে প্রিয়জনের যা কিছু প্রিয় তার সঙ্গেও ভালোবাসা হবে। তাহলে নবীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকল কিছুর সঙ্গে মহব্বতের সম্পর্ক কায়েম হওয়া নবী-মহব্বতের স্বাভাবিক দাবি, আর শরিয়তও এর তাকিদ করেছে।
যে কোনো মানুষের নামই তার সত্তার পরিচয় বহন করে থাকে। সে নাম ধরেই তাকে স্মরণ করা হয় আবার সে নামেই সে পরিচিতি লাভ করে। এ জন্য কারো নাম তার সত্তা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নামের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন মূলত ব্যক্তির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন। অনুরূপভাবে কারো নামের প্রতি বিরূপভাব ও অবজ্ঞা প্রকাশ মূলত ব্যক্তিরই প্রতি বিরূপ ও অবজ্ঞার শামিল।
শরিয়ত যে কোনো বস্তু বা ব্যক্তির নাম সর্ম্পকে বহু আহকাম প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে কুরআনে হাকিমের একাধিক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আর হাদিসের কিতাবসমূহে তো এ সম্পর্কে এক বড় ও ভিন্ন অধ্যায়ই বিদ্যমান রয়েছে। নাম সম্পর্কিত শরয়ী আহকামসমূহের মধ্যে একটি হলো এই যে, কোনো নামেরই বিকৃতি ঘটানো যাবে না এবং তা নিয়ে বিদ্রূপও করা যাবে না।
তবে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামের ব্যাপারটি সাধারণ এ হুকুম থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বহু ঊর্ধ্বে। কেননা, তাঁর নামের বিষয়টি হলো সরাসরি দ্বীন ও ঈমানের বিষয় এবং ইসলামের শিআর ও নিদর্শন। এ নামের তাজীম করেছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, তাঁর ফেরেশতাগণ এবং তিনি নিজেই এ নামের তাজীমের নির্দেশ প্রদান করেছেন।আর এরচেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা কালেমায়ে তাওহিদ, কালেমায়ে শাহাদাত, যা ঈমানের কালেমা ও শিয়ারে ইসলাম, তাতে নিজের নামের সঙ্গে রাসূলের নাম যুক্ত করেছেন। আজানে ও নামাজের তাশাহহুদে প্রিয়তমের নামও শামিল করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : আর আমি আপনার আলোচনা সমুচ্চ করেছি। (সূরা ইনশিরাহ : ৪)।
এই ইলাহি ইকরামের কথা বলা হয়েছে। আমরা কি কখনো ভেবেছি, প্রতিদিন পাঁচবার কত লক্ষ মসজিদের মিনারে-মিনারে ধ্বনিত হয়, ‘আল্লাহু আকবার’। আর তারই সঙ্গে ধ্বনিত হয় ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহর সুমধুর ধ্বনি কিংবা এভাবেও কি ভেবেছি যে, যে নামের কালেমা পাঠ করে মানুষ ঈমানদার হয় আর যে নামের কালেমা অস্বীকার করে ঈমান হারায় তার মাহাত্ম্য কতখানি। এ নামের সঙ্গে সামান্যতম বেয়াদবি কত বড় অপরাধ। বলাবাহুল্য, এটা এমন কোনো অস্পষ্ট বিষয় নয় যা বোঝোনোর প্রয়োজন হতে পারে।আর এটা বাস্তব যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মর্যাদা সম্পর্কে তিনিই সবচেয়ে বেশি অবগত, যিনি তাঁর স্রষ্টা এবং তাঁকে এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছেন। রাসূলের উম্মতী যতই তাঁর মাহাত্ম্য বয়ান করুক শেষে অক্ষমতা স্বীকার করে বলতে হয় যে, ‘ভাবনার আস্তীন খাটো কিন্তু সৌন্দর্যের ফুল অনেক, কিংবা বলতে হবে/ খোদার পরেই তোমার মকাম’।
লেখকঃ কলেজের অধ্যাপক

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *