আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা ঊর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। পারিভাষিক অর্থে ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়’।প্রচলিত অর্থে, ঈদুল আযহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ পন্থায় যে পশু যবাহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়’। সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে ‘কুরবানী’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে।যদিও কুরবানী সারাদিন ও পরের দু’দিন করা যায়।
কুরবানি মুসলনমানদের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। যুগ যুগ ধরে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। কুরবানি দেওয়ার রীতি পৃথিবীর আদিকাল থেকেই চলে আসছে। এর মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য অনেক। মূলত ঈদুল আজহা হচ্ছে পশু কুরবানির মাধ্যমে নিজের অন্তরের পশুত্বকে জবাই করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ত্যাগ স্বীকার করা।
আল্লাহর নবি হজরত ইবরাহিম (আ)কর্তৃক পুত্র ঈসমাইল (আ)কে কুরবানির পরীক্ষার মাধ্যমই বর্তমানে প্রচলিত কুরবানির সূত্রপাত হয়েছে। ইসলামি শরিয়তে মুসলিম জাতির জীবনটাই একটি কুরবানিতুল্য। এ কুরবানি হতে পারে- জীবনের, অর্থের, সম্পদের, সময়ের, স্বার্থের, ইচ্ছার ও পশু জবাইয়ের। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থ, সম্পদ ও আত্মত্যাগের মহিমাই হলো কুরবানি।
হজরত ইবরাহিম (আ)-এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান দিনটি এই শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত ভালোবাসা সম্পদে নয়, ভোগে নয় বরং ত্যাগে। মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য ত্যাগের মধ্যেই প্রকৃত সুখ। ঈদুল আজহার অর্থ নিছক পশু হত্যা নয় বরং ত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার। পশু কুরবানি হচ্ছে আত্ম কুরবানির প্রতীক। কুরবানির পশু জবাই আসলেই প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন, পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার কাছে পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু বান্দার তাকওয়া ও পরহেজগারি।
শুধু পশু নয়, পশুত্বের কুরবানি দিতে হয়। প্রতিটি মানুষের ভিতর নফসে আম্মারা নামক একটি হিংস্র পশু আছে ,যা প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় ও পাপ কাজে প্ররোচিত করে থাকে এবং আত্মাকে পাপিষ্ঠ আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপিষ্ঠ আত্মা। মানুষের অন্তরাত্মা পাপে ভরা, যেটার সম্মিলিত নামই পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ঠ আত্মা অর্থাৎ পশুত্বকে কুরবানি করার পর পশু কুরবানি করা উচিৎ।
প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের ওপর কুরবানি করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। মহান আল্লাহ তায়ালা হয়রত ইসমাইল (আ.) কে স্বপ্ন যোগে তার প্রিয় বস্তু কুরবানি করার নির্দেশ প্রদান করেন। এতে তিনি পরপর তিন দিন তিনটি পশু কুরবানি করেন। তারপরও স্বপ্ন দেখেন প্রিয় বস্তু কুরবানি করার। এরপর আর বুঝতে বাকি রইল না যে আল্লাহ তার প্রাণ প্রিয় সন্তান হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে কুরবানি করতে আদেশ করছেন। তিনি ও তার প্রিয় পুত্র উভয়ই সৃস্টিকর্তাকে খুশি করতে কুরবানির জন্য পস্তুত। উভয়ের দুচোখ বেঁধে কুরবানির কাজ শেষ করা হলো। তারপর চোখ খুলে দেখা গেল কুরবানি হয়েছে একটি দুম্বা। মহান আল্লাহর এ নির্দেশ থেকে আমরা শিক্ষা পেলাম আমাদের প্রিয় বস্তু কুরবানি করতে হবে। আমি যাকে আদর-যত্ন করে, লালন-পালন করে ভরন-পোষণ করেছি এমন বস্তু বা পশু। বাজার থেকে কিনে এনে সাথে সাথে কুরবানি না করে ২/৩ দিন আগে এনে একটু আদর যত্ন করে মায়া সৃষ্টি করে প্রিয় বস্তুতে রূপান্তর করার পর আমরা যেন কুরবানি করি। ঈদুল আজহার দিন ঈদের সালাতের পর কুরবানি করা প্রসঙ্গে রাসূল (সা)বলেন- যে ব্যক্তি ঈদের আগে পশু যবেহ করল, তার উচিত ঈদের নামাজের পর আরেকটি কুরবানি করা (বুখারী ও মুসলিম)। কুরবানি করার সময় চার দিন। অর্থাৎ ঈদের দিন এবং তার পরবর্তী তাশরীকের তিন দিন। যেহেতু রাসূল(সা) বলেছেন :তাশরীকের দিন কুরবানির দিন (সহীহ হাদীস সমগ্র : ২৪৬৭)।
কুরবানি অনুমোদনের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন— “অতএব তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যেই সালাত পড় এবং কুরবানি কর”(কাউসার : ২)। তিনি আরো বলেন— “আর কুরবানির উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি” (হজ :৩৬)। কুরবানীর সামর্থ থাকা সত্বে তা ত্যাগ করা মাকরুহ। আনাস (রা) বুখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনা মতে— মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) তরতাজা ও শিং ওয়ালা দুটি মেষ নিজ হাতে যবেহ করেছেন এবং তিনি তাতে বিসমিল্লাহ ও তাকবীর বলেছেন। কুরবানির পশু হিসেবে উঠ, গরু ও বকরি বা দুম্বা ছাড়া কুরবানি শুদ্ধ হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন : যাতে তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, যে সমস্ত পশু তিনি রিয্ক হিসেবে দিয়েছেন তার ওপর (হজ্ব : ৩৪)। কুরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য ত্রুটি মুক্ত পশু হওয়া জরুরী, এ প্রসঙ্গে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেন : কুরবানির পশুতে চারটি দোষ সহনীয় নয় : স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট অসুস্থ্য, হাড্ডিসার ও ল্যাংড়া পশু (তিরমিযী : কিতাবুল হজ : ৩৪)। যে সুন্দর করে যবেহ করার ক্ষমতা রাখে তার উচিত নিজ হাতে কুরবানি করা। কুরবানি করার সময় যার নামে কুরবানী করা হচ্ছে তার নাম বলবে এবং বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে ছুরি চালাবে। যেমন রাসূল (সা)বলেছেন : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার; হে আল্লাহ, এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের মধ্যে যারা কুরবানি করেনি, তাদের পক্ষ থেকে (আবূদাউদ ও তিরমিযী)।
কুরবানির গোস্ত কুরবানিকারী ব্যক্তির জন্য সুন্নত হলো নিজে খাওয়া আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরন এবং গরীবদের দান করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ-দরিদ্রকে খেতে দাও (হজ্ব : ২৮)। বর্তমানে প্রায় কুরবানি শুধুমাত্র একটি নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। লোক দেখানো পশু কেনা, পশু কিনতে গিয়ে প্রতিযোগিতা ও আড়ম্বড়তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ কুরবানি করার বিধান এ জন্য হয়নি।
লোক দেখানো ইবাদত নিশ্চয়ই আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার নয়। মহান স্রষ্টার প্রতি যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তাঁর সন্তুষ্টি ও মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে সারা বিশ্বে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয় । এ উৎসব আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কুরবানির উৎসব। ঈদুল আজহার দিন সকালে ঈদের নামাজ শেষ করে আমরা পশু কুরবানি করি। এটা শরীয়তের বিধান।
তাই আমাদের ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধকে জাগ্রত করতে হবে। যথাযথভাবে কুরবানি করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও বান্দার ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। তবেই কুরবানি পালনের যথার্থতা উপলব্ধি করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের কুরবানির ত্যাগ ও উৎসর্গকে কবুল করুন। আমিন।
লেখকঃ মোঃ কামাল উদ্দিন,লেকচারার,ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,আতাকরা কলেজ,কুমিল্লা।