ইসলামে প্রতারণা একটি জঘন্যতম অপরাধ

ইসলামে প্রতারণা একটি জঘন্যতম অপরাধ

প্রতারণা মানব চরিত্রের একটি মারাত্মক রোগ। প্রতারণা বা কৌশলে অন্যকে ঠকানো কবিরা গোনাহ তথা হারাম। ইরশাদ হয়েছে , ”এরা মহান আল্লাহ ও তাঁর নেক বান্দাদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তারা অন্য কাউকে নয় নিজেদেরই প্রতারিত করছে। অথচ তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। (আসলে) এদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি। (প্রতারণার কারণে) মহান আল্লাহ তাদের ব্যাধি বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে তাঁর পক্ষ থেকে লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি। কেননা তারা মিথ্যা বলেছিল” (সূরা বাকারা : ৯-১০)।

কাউকে ঠকানো এবং কারো সঙ্গে প্রতারণামূলক আচরণ করা কোনো সমাজেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম এটাকে আরো কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। ইসলামের পরিভাষায় মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী কাউকে ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করাই প্রতারণা। ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ছাড়াও মানুষ বিভিন্ন আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে পারস্পরিক প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা করে থাকে। মানুষের মধ্যে এমন কিছু খারাপ গুণ রয়েছে যে গুণগুলো ব্যক্তিকে মানুষের কাছে নিন্দনীয় এবং মহান আল্লাহর কাছে অপরাধী করে দেয়। এমন একটি গুণ হলো প্রতারণা বা ধোঁকা। ইসলামে প্রতারণা সম্পূর্ণ হারাম। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে ”দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় সম্পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে। আর তাদের যখন মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। তারা কি বিশ্বাস করে না যে তারা মহাদিনে পুনরুত্থিত হবে । সেদিন সব মানুষ সৃষ্টিকুলের রবের সামনে দাঁড়াবে” (সূরা মুতাফফিফিন ১-৬)। ইসলামের দৃষ্টিতে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা যেমন জঘন্য অপরাধ। তেমনি ধোঁকাবাজরা তাদের অপকর্মের মাধ্যমে শুধু অপরকেই প্রতারিত করে না। বরং নিজেদেরকে এই অপরাধ বলয়ের মধ্যে জিম্মি করে ফেলে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন ”ধোঁকা ধোঁকাবাজদেরই ঘিরে ফেলে” (সূরা ফাতির : ৪৩) ।

যারা প্রতারণা বা ধোঁকাবাজির সঙ্গে জড়িত, তাদের পরিণাম যে ভয়াবহ তা স্পষ্ট করা হয়েছে হাদিসের বর্ণনায়। মহানবী (সা.) বলেন, ”ধোঁকাবাজ ও প্রতারক জাহান্নামী”। অন্যত্র বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সা.) বলেন, ”পাঁচ ব্যক্তি জাহান্নামী হবে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে যে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাবস্থায় কারও ধন- সম্পদ ও পরিবার-পরিজন সম্পর্কে ধোঁকা দেয়” (সহিহ মুসলিম)। প্রতারণা, প্রতারণার নোংরা এলাকায় পা বাড়ানো, তার ভয়াবহ ঘেরাটোপে আটকে পড়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য এ উক্তিই আমাদেরকে সরল পথ দেখাবে। এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ”তারা যদি তোমাকে ধোঁকা দিতে চায়, তবে মহান আল্লাহই তোমার জন্য যথেষ্ট। তিনিই নিজ সাহায্যে মুমিনদের দ্বারা তোমাকে শক্তিশালী করেছেন” (সুরা আনফাল, আয়াত : ৬২) । ওই আয়াতসমূহে মহান আল্লাহ ধোঁকাবাজদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তারা মুখের কথার মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও মুমিন বান্দাকে ধোঁকা দিতে চায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাই ধোঁকার শিকার হয়েছে। কেননা, এ ধোঁকার পরিণাম তাদের জন্য অশুভ হবে। তারা মনে করছে নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয় দিয়ে তারা কুফরের পার্থিব পরিণতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। অথচ আখেরাতে তাদের জন্য কঠিন আজাব অপেক্ষা করছে। মহানবী (সা.) ধোঁকা ও প্রতারণাকারী সম্পর্কে কঠোর বাক্য উচ্চারণ করেছেন।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ”ধোঁকাবাজ ও প্রতারণাকারী জাহান্নামে যাবে” (শুআবুল ঈমান বাইহাকী, হাদিস : ৬৯৭৮) । জেনে রাখা উচিত যে, প্রতারণার সুনির্দিষ্ট কোনো ক্ষেত্র নেই। বরং নানাভাবে প্রতারণা করা হয়ে থাকে। কথাবার্তা, কাজকর্ম, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভেজাল মেশানো, পণ্যদ্রব্যের দোষ গোপন করা, মানুষকে ঠকানো, লটারি জেতার কথা বলে প্রতারণা, মাছ ও সবজিতে ফরমালিন মেশানো, জাল টাকা চালিয়ে দেওয়া, ওজনে কম দেওয়া, বেশি দামের জিনিসের সঙ্গে কম দামের জিনিস মিশিয়ে দেওয়া, মিথ্যা হলফ করে অন্যের হক নষ্ট করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া প্রভৃতি। এককথায়, যে কোনোভাবে যে কোনো প্রাণীকে ঠকানোই মানে ধোঁকা। পাঠক আপনার চারপাশে একটু নজর করে দেখবেন সর্বত্র প্রতারণা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নানাবিধ কৌশল রয়েছে। যেমন- রডের বদলে বাঁশ, খাদ্যে ভেজাল, মাপে কম দেওয়া, দুধে পানি মেশানো, মাছের ওজন বাড়ানোর জন্য সিসা ব্যবহার করা, মালিকের অনুপস্থিতিতে শ্রমিকের কাজে ফাঁকি দেওয়া। মেকাপ দিয়ে প্রকৃত চেহারা ঢেকে দেওয়া ইত্যাদি। এসব কিছুই প্রতারণার শামিল।

মহানবী (সা.) বলেন, ”তোমরা সদা সত্য কথা বল। নিশ্চয়ই সত্য কথা সৎ কর্মের দিকে পরিচালিত করে। একজন সত্যবাদী মুসলমান ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন শহীদদের সাথী হবে অর্থাৎ শহীদদের সঙ্গে হাশর হবে” (আল মুসতাদরিকুল হাকিম)। রোগের স্যাম্পল নিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন দেয়া এবং এর মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া মারাত্মক প্রতারণার শামিল। উক্ত অপরাধ শুধু ব্যক্তির ক্ষতি করে না বরং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে। যারা মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ”মুমিন একই গর্তে দুইবার দংশিত হয় না” (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৬২)। এবং মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রোগী ভর্তি করানো এবং রোগের সঠিক পরীক্ষা না করে রিপোর্ট দেয়া এবং সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়া। বিদেশে নেয়ার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেয়া। অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে ভেজাল দেয়া। বেকার যুবকদের নিয়ে যৌথ ব্যবসার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেয়া এই সবই প্রতারণার অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃত মুসলমান ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে এ ধরনের কাজের জন্য কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেন, ”যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়” (মুসলিম : ১০২)।

শুধু এই পদ্ধতিতেই নয়। আরো অনেক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের যুবকদের প্রতারিত করা হচ্ছে। যুবকদের উচিত এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পা না দিয়ে দক্ষতা অর্জন করা। হালালভাবে উপার্জন করা। বর্তমানে জনমনে আল্লাহ তায়ালা ও পরকালের ভয় সৃষ্টি করা ছাড়া জগতের কোনো আইন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী অপরাধ দমনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। যারাই মহান আল্লাহ, নবী, মুমিন বান্দাদেরকে ধোঁকা দেবে তারাই কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।

তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত অন্তরের মধ্যে মজবুত ঈমান লালন করা এবং ঈমানের কথাই প্রকাশ করা আর সে অনুযায়ী আমল করা। তাহলেই সে প্রকৃত মুমিন হতে পারবে। মুখে এক কথা আর অন্তরে আর এক কথা এটা কোনো মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হলো সে কখনও ধোঁকা দেবে না এবং ধোঁকার শিকার হবে না। যুগে যুগে ধোঁকাবাজ ছিল, এখনও আছে। চলমান সমাজকে যদি শান্তিময় ও সুখময় করতে হয়, যদি শান্তির অনাবিল নীড় গড়তে হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের ধোঁকা প্রতারণা ও ভেজাল ছাড়তে হবে। তাহলেই সমাজ স্বচ্ছ, সুন্দর ও কল্যাণময় হয়ে ওঠবে। তাই মহান আল্লাহর কাছে এই কামনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে ধোঁকা ও প্রতারণার কাজ থেকে হেফাজত করে এবং প্রকৃত মুমিন হওয়ার তৌফিক দান করে। আমিন।।

লেখকঃ মো: কামাল উদ্দিন, প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আতাকরা কলেজ, কুমিল্লা।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *