ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম, শরিয়ত হলো মানবিক বিধান। একজন মানুষকে বিশ্বাসী মুমিন ও অনুগত মুসলিম হতে হলে কিছু প্রাথমিক মৌলিক গুণ অর্জন করতে হবে। প্রাকৃতিক গুণাবলির মাধ্যমে মানুষ অন্য সব সৃষ্ট জীব ও প্রাণিকুল থেকে আলাদা। মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক চেতনায় মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। গুণ বলতে সাধারণত সৎ গুণ ও সুকুমারবৃত্তিকেই বোঝায়। গুণাবলি দ্বারাই মানুষের ব্যক্তিত্ব নির্ধারিত হয়।
ইসলাম ব্যক্তির বিশ্বাস ও আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করে। আমল তথা কর্ম বা আচরণ বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। মানুষ তার প্রাপ্ত বা অর্জিত জ্ঞান ও বিশ্বাসের আলোকেই বস্তু ও ব্যক্তির সঙ্গে আচরণ করে থাকে। ইসলামের লক্ষ্য হলো স্রষ্টা ও সৃষ্টির সঙ্গে তার প্রাপ্য অধিকার অনুযায়ী যথাযথ আচরণ বা কর্ম সম্পাদন করা।
মুমিন ও মুসলিম হলো সত্য বিশ্বাসী ও বিশেষ সৎ গুণাবলির অধিকারী ব্যক্তি। মানুষের প্রাকৃতিক রিপু হলো কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য। অনিয়ন্ত্রিত ষড়্রিপু সুকুমারবৃত্তির শত্রু। জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত এসবের সঙ্গে হরদম সংঘাত চলতে থাকে। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারবিধি হলো শরিয়ত বা ইসলামি বিধান। প্রাকৃতিক গুণাবলির সঠিক ব্যবহারেই জীবনের সফলতা এবং এর ভুল ব্যবহারই ব্যর্থতা। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)।
মানবচরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই নবী–রাসুল প্রেরণের মূল লক্ষ্য। এ মহান লক্ষ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)– কে পাঠিয়েছেন মানবতার উৎকর্ষের পূর্ণতা প্রদানের জন্য। তিনি বলেন, ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে মুহাম্মদ সা.) নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা-৬৮ কলম, আয়াত: ৪)।
মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। মানব সৃষ্টির আগে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলেছিলেন, ‘আমি দুনিয়াতে (আমার) খলিফা স্থলাভিষিক্ত করব।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩০)। প্রেরিত প্রতিনিধির দায়িত্ব হলো প্রেরণকারী মালিকের পক্ষে তার কর্ম সম্পাদন করা। এ জন্য তার মধ্যে সে গুণাবলি থাকতে হবে। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর রং! তদপেক্ষা উত্তম আর কোনো রং হতে পারে?’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৩৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও।’ আল্লাহর রং ও গুণ হলো তাঁর নিরানব্বইটি গুণবাচক নাম। আল্লাহ তাআলা চান মানুষ সেসব গুণ অর্জন করুক এবং মানুষের মধ্যে এসব গুণ বিকশিত হোক, সমাজে এসব গুণের চর্চা হোক।
ইসলাম হলো সত্য বিশ্বাস, শ্রেষ্ঠ দর্শন, উত্তম আদর্শ, সৎ গুণাবলি ও কল্যাণ কর্মের নাম। জন্মসূত্র, বংশ, অঞ্চল, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও পেশা—এসব পরিচয় ইসলামে গৌণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে, অতঃপর তোমাদিগকে বিভিন্ন শাখা ও গোত্রে বিভাজন করেছি; যাতে তোমরা পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে তোমাদের সেই বেশি সম্মানিত যে বেশি তাকওয়াবান।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।
হজরত নূহ (আ.) এর ঔরসজাত সন্তানও অবিশ্বাসের কারণে এবং সৎ গুণের অভাবে নবীপুত্র হয়েও মুক্তি পাননি। আল–কোরআনের বর্ণনা, ‘নুহ (আ.) তাঁর রবকে আহ্বান করে বললেন, “নিশ্চয় সে আমার পুত্র-আমার আহল আর আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য এবং আপনি সকল বিচারকের শ্রেষ্ঠ বিচারক।” (আল্লাহ) বললেন, হে নুহ! নিশ্চয় সে আপনার আহল (অনুসারী) নয়, কারণ তার কর্ম সঠিক নয়।’ (সুরা-১১ হুদ, আয়াত: ৪৬)।
ইসলামি বিশ্বাসে প্রয়োজনীয় গুণাবলির অধিকারী হলে সে সুফলপ্রাপ্ত হবে; নচেৎ বংশমর্যাদা তাকে সফলতা দিতে পারবে না, বরং সত্য বিশ্বাস, সততা, উত্তম আদর্শ ও সৎকর্মের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কোরআন মাজিদে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে, ‘আল্লাহ যখন ইব্রাহিম (আ.)–এর বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা নিলেন এবং তিনি তা সুসম্পন্ন করলেন; (আল্লাহ) বললেন, নিশ্চয় আমি আপনাকে মানুষের ইমাম (নেতা) বানাব। তিনি বললেন, আমার বংশধরেরাও কি এই দায়িত্ব পাবে? (আল্লাহ) বললেন, জালিমরা আমার প্রতিশ্রুতি পাবে না।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৪)।
ইসলামে মানবিক মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনের সময় এসেছে। ইসলামের নামে যেখানে এত দল বিভক্তি, এত আহ্বান, আবার ইসলামের বিরুদ্ধে যেখানে এত বিষোদগার আর এত আক্রমণ সেখানে মুমিনের অধিক সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। ইসলামি অনুশাসনের নিয়ম-নীতির পাশাপাশি এর মহত্তম কল্যাণবোধের দিকটি দক্ষ কুশলতায় ফুটিয়ে তোলা দরকার। মানুষের কাছেই মানুষের অনিরাপত্তা ও ভয়ঙ্কর শত্রুতা ভরা পৃথিবীতে ইসলামের কল্যাণময় ঔদার্য বিপুল জনগোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান দিতে পারে।ইসলামের বিধান মানুষের জন্য। তাই মুসলিম হতে হলে প্রথমে মানুষ হতে হবে আর মানুষ হতে হলে মানবীয় গুণাবলি ও মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী হতে হবে। সামাজিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় হতে জাতিকে রক্ষা করতে হলে নৈতিকতা মূল্যবোধ শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর কাছে মুমিনদের স্বপ্নের চাওয়া, “হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে দুনিয়ার কল্যাণ দান করুন। আর পরকালের কল্যাণও।আর আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।” আমিন।।
লেখকঃ মোঃ কামাল উদ্দিন
প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আতাকরা কলেজ, কুমিল্লা, বাংলাদেশ।
ইমেইলঃ mskamal124@gmail.com