প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (রেজ্যুলেশন নং-৪৫/১০৬)।
১৯৯১ সাল থেকে শুরু হওয়া এ দিবসটি পালনের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ০১ অক্টোবর বিশ্ব জুড়ে উদযাপন করা হচ্ছে ৩২তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ অনুসারে বাংলাদেশে ৬০ বছর এবং তদুর্ধ বছর বয়সীরা হচ্ছেন প্রবীণ। বিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, সচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন মৃত্যুহার যেমন হ্রাস করেছে; পাশাপাশি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বিশ্ব সমাজে বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখের বেশি প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। মানুষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকে, যার ফলে প্রবীণ ব্যক্তিদের বেলায় বেশ কিছু অসুস্থতা প্রায় সবার মধ্যে দেখা দিয়ে থাকে।একটা মানুষ যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তার নিজের মধ্যেই কিছু কিছু জিনিস দানা বেধে ওঠে। যেমন- শারীরিক অসামর্থ্য, অসহায়ত্ব, পরনির্ভরশীলতা, অদৃষ্টের উপর সমর্পণতা ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। এসব কারণে মানসিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে নিজেকে অবাঞ্ছিত, পরিবারের বা সমাজের বোঝা মনে করেন। অনেক প্রবীণই বিষণ্ণতায় ভোগেন। অনেক সময় এমন অযৌক্তিক ও শিশুসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে প্রকাশ পায়, যাকে অনেকেই দ্বিতীয় শৈশব বলে মনে করেন। প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রবীণরা যৌবনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পরিবারের সদস্যদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করেছেন। জীবনের এ পর্যায়ে এসে তারা অবহেলিত হবেন, এটা মেনে নেয়া যায় না। যেহেতু এ সময় কর্মক্ষম হয়ে যায়, তাই সংসার পরিবার কিংবা সমাজের সে হয়ে যায় অনেকটা মূল্যহীন। অনেকে প্রবীণদের সংসারের বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, কিংবা বাড়ি থেকে বের দেয়। ফলে তাদের অমর্যাদাকর করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব ইসলামেরও শিক্ষা নয়, মানবিক কোনো কাজ নয়। অথচ ইসলামের প্রবীণদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রবীণদের বিশেষ মর্যাদার কথা রাসূল (সা) বর্ণনা করেছেন। হজরত আমর বিন শোয়াইব বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) সাদা চুল উঠাতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা মুমিনের নুর। তিনি আরও বলেন, যদি কেউ সাদা চুল বিশিষ্ট হয় আল্লাহ তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন, একটি পাপ মোচন করে দেন এবং একটি পুণ্য লিখে দেন’ – (আহমাদ: ৬৯৩৭, আবু দাউদ: ৪২০২)। রাসূল(সা.)আরও বলেন, যে মুসলিম সাদা চুল বিশিষ্ট হবে, কিয়ামতের দিন এটা তার জন্য আলো হবে–(তিরমিজি: ১৬৩৪)।
প্রবীণ কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্তির বিষয়ে রাসূল(সা.)বলেন, প্রবীণদের সঙ্গেই তোমাদের কল্যাণ, বরকত রয়েছে।–(ইবনে হিববান: ৫৫৯)। অধিক বয়সীদের বিশেষ মর্যাদা প্রসঙ্গে রাসূল(সা.)বলেছেন, আমি কি তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তির সংবাদ দেবো না? সাহাবীগণ বলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে দীর্ঘ আয়ু লাভ করে এবং সুন্দর আমল করে -আহমাদ: ৭২১২। আরেক হাদিসে হজরত রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়–( তিরমিজি)।
আল্লাহ তায়ালা পিতা-মাতার প্রতি বার্ধক্যকালে তাঁদের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বলেন, … এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সঙ্গে নরমভাবে কথা বলো… (সূরা বনি ইসরাঈল: ২৩-২৪)।
এখানেই শেষ নয়, পিতা-মাতা অমুসলিম হলেও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। এক কথায়, প্রবীণদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা মুসলমানদের দায়িত্ব। তাদের প্রয়োজন পূরণ করা সকলের প্রতি কর্তব্য। বিশেষ করে নিকটাত্মীয়দের এটা মানবিক দায়িত্বও বটে। এভাবে ইসলাম প্রবীণদের মূল্যায়ন ও সম্মান করেছে। তাছাড়া আরও যেসব ক্ষেত্রে প্রবীণদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, তা হলো-
সালামে অগ্রাধিকার, নামাজ আদায়ে বিশেষ সুবিধা, এমনকি প্রবীণদের সম্মানে নবী করিম (সা.) ইমামকে নামাজ সংক্ষিপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রবীণদের ইমামতিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি রোজা পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন, হজের ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ অর্থাৎ বদলি হজের বিধান দিয়েছেন এবং হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নৈকট্যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।রাসূল(সা.)বলেন, তোমাদের মধ্যকার প্রবীণ ও জ্ঞানী লোকেরা যেন আমার কাছাকাছি দাঁড়ায়। তারপর পর্যায়ক্রমে দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি, তারপর দাঁড়াবে যারা তাদের কাছাকাছি তারা। -(সহিহ মুসলিম: ৪৩২)।
বসার দিক অগ্রাধিকার বিবেচনায় ওবায়দুল্লাহ বিন ওমর বলেন, আমি সোলায়মান বিন আলীর নিকট ছিলাম। এ সময় কোরাইশ গোত্রের জনৈক প্রবীণ ব্যক্তি প্রবেশ করলো। সোলায়মান বললেন, এই প্রবীণ ব্যক্তির দিকে লক্ষ্য করো, তাকে উপযুক্ত আসনে বসাও। -(আহমাদ: ৪৬০)।কথা বলায় অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে এক বর্ণনায় এসেছে একবার আবদুল্লাহ ইবন সাহল ও মুহাইয়াছা খাদ্যের অভাবে খায়বারে আসেন। ঘটনাক্রমে আবদুল্লাহ নিহত হলে রাসূল (সা.)-এর নিকট ঘটনাটি বলার জন্য মুহাইয়াছা অগ্রসর হয়। তখন রাসূল (সা.) মুহাইয়াছাকে বললেন, বড়কে কথা বলতে দাও; বড়কে কথা বলতে দাও। তিনি এতে বয়সে প্রবীণ ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করেছেন। (-সহিহ বোখারি: ৭১৯২)
ইসলামে প্রবীণদের ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেহেতু শেষ বয়সে শারীরিক কারণে ইবাদত-বন্দেগি করতে কষ্ট হয়, আর কষ্ট স্বীকার করে যে ইবাদত-বন্দেগি করা হয়, আল্লাহতায়ালা তা কবুল করেন। তাই শেষ বয়সে ইবাদত-বন্দেগির মাত্রা যথাসাধ্য বাড়িয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া প্রবীণদের কর্তব্য হলো- আত্মীয়-স্বজনদের যথাসম্ভব খোঁজ-খবর নেওয়া ও দোয়া করা। যেমন হজরত ইবরাহীম (আ) বৃদ্ধ অবস্থায় তার ছেলে হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান। এক সঙ্গে কাবা ঘর নির্মাণ করেন এবং তাদের জন্য ও পরবর্তী বংশধরের জন্য দোয়া করেন। -সহিহ বোখারি: ৩৩৬৪
পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রবীণরা অবহেলিত, উপেক্ষিত, সমাজে ও পরিবারে অনেকের কাছে বোঝাস্বরূপ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সবার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া অবশ্য কর্তব্য।
* প্রথমে মনে রাখতে হবে প্রবীণ বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের পরিবারেরই অংশ। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতই তার সঙ্গে আচরণ করতে হবে। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত সবসময় প্রবীণদের আদরযত্ন দিয়ে শিশুদের মতো প্রতিপালন করা। তাদের প্রতি মায়ামমতা, ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। কোনোক্রমেই তাদের মধ্যে যেন এই ধারণা না হয় যে, তারা আমাদের জন্য একটি অতিরিক্ত বোঝা।
# সন্তানহীন প্রবীণদের জন্য সরকারিভাবে বৃদ্ধনিবাস বা ওল্ডহোমের ব্যবস্থা করতে হবে।
# সরকারি কর্মচারী চাকরি হতে অবসর নেওয়ার পর সামান্য পরিমাণ পেনশন ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু প্রবীণ কি শুধু তারাই? সরকারি চাকরির বাইরে যারা অন্য পেশায় যারা আছেন বা ক্ষেতে ও খামারে কাজ করেন, তারা কি বৃদ্ধ হবেন না? সুতরাং তাদের জন্যও সুযোগ সুবিধা থাকা জরুরি। সরকারকে তা অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত।
# পেনশন বা বয়স্কভাতা হিসেবে যে অর্থ দেয়া হয়, তার পরিমাণটাও সম্মানজনক হওয়া উচিত, যাতে তারা খেয়েপড়ে চলতে পারেন এবং পরনির্ভরশীল হতে না হয়।
# প্রবীণরা যাতে স্বল্প ব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা পেতে পারেন, সেজন্য পর্যাপ্ত হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে তাদের জন্য আলাদা সিট বরাদ্দ থাকা জরুরি। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ওষুধ তাদের বিনামূল্যে বা অল্পমূল্যে দেওয়া জরুরি। এছাড়া প্রবীণদের চিকিৎসার জন্য বড় হাসপাতালগুলোতে বিশেষায়িত বিভাগ খোলা উচিত।
# পরিবারের সদস্যদের বা ছেলেমেয়েদেরকে প্রবীণদের বিষয়ে মনোযোগ দেয়া উচিত।
# বিভিন্ন সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় এমনকি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যথাসম্ভব প্রবীণদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত, যাতে তারা নিজেদের কোনোক্রমেই অপ্রয়োজনীয়, উপেক্ষিত বা অবহেলিত মনে না করেন।
আজকের এই দিনে প্রবীণদের আহ্বান হচ্ছে- কেবল আবেগ-অনুকম্পা অথবা দয়া-দাক্ষিণ্যে নয়, অধিকার আর প্রাপ্য সন্মানের ভিত্তিতে জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠী নির্বিশেষে অনিন্দ্য সুন্দর এই বাংলাদেশে আমরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে আর স্বস্তিতে বসবাস করি।
পরিশেষে আমার একটি ক্ষুদ্র পরামর্শ হচ্ছে, আজকের প্রবীণদের সঙ্গে আমাদের ব্যবহার ভবিষ্যতের জন্যে একটা বিনিয়োগ। আমাদের সন্তানরা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা আমাদের অনেক কিছুই অনুকরণ করে শেখে।সবচেয়ে বড় কথা হলো- ইসলামের শিক্ষাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যেক বৃদ্ধের ছেলে-সন্তানসহ মা-বোনদেরকেই এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মুসলমানদের উচিত নিজেদের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রবীণদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা এবং এর মাধ্যমে নিজেদের ইহ-পরকালের মুক্তির ব্যবস্থা করা। বিশ্বের সব প্রবীণ ভালো থাকুন এবং এবারের বিশ্ব প্রবীণ দিবস সফল হোক এ প্রত্যাশায়।আল্লাহ তাআলা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে প্রবীণদের প্রতি যত্ন নেয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,আতাকরা কলেজ, কুমিল্লা, বাংলাদেশ ।