1. [email protected] : thebanglatribune :
বঙ্গদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প-মোঃ হাবিবুর রহমান - The Bangla Tribune
ডিসেম্বর ১১, ২০২৩ | ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প-মোঃ হাবিবুর রহমান

  • প্রকাশের সময় : সোমবার, আগস্ট ১, ২০২২

বঙ্গদেশে অনেক শাসক শাসন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেও তারা বেশি দিন এ অঞ্চল নিজেদের অধিকারে রাখতে পারেনি। কারণ বরাবরই এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনচেতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছিল। প্রাচীনকালে এ অঞ্চল বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিলো। এ সকল জনপদ যথাক্রমে বঙ্গ, গৌঢ়, পুন্ড্র, হরিকেল, ও সমতট নামে পরিচিত ছিলো।

এ সকল অঞ্চলে যে সকল শাসক শাসন করেছিলেন, তারা কখনো প্রজাদের সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলত, প্রজারা হয়ে উঠেছে বিদ্রোহী ও সাম্রাজ্যবিরোধী শক্তি। নিজের রক্ত ও স্বজাতীর আত্নত্যাগের বিনিময়ে ঐ সকল পরাশক্তি শাসকগোষ্ঠী থেকে মুক্তি করে নিয়েছিলো। যদিও এ অঞ্চলে কখনো দাপট ছিলো আরিয়ানদের, কখনো বা ডাচদের প্রতাপে এ জনপদ কেঁপেছিলো। কখনো আলাল ও দুলালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ফরাসি ও বৃটিশ বাহিনী। শাসকের ক্ষমতার পালাবদল হলেও প্রজাদের ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয়নি। বরং ফ্রান্স ও বৃটিশদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাননি। অবশেষে বৃটিশদের একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু হয়। এ ব্রিটিশরা মূলত ইংরেজ নামেও অভিহিত হতো এবং ইংল্যান্ডের অধিবাসী ছিলো। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে জয় লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করে। যদিও বলা হয়ে থাকে, ব্রিটিশ সূর্য কখনো অস্তমিত হয় না। তবে, এ প্রবাদ বঙ্গদেশের জন্যে প্রযোজ্য ছিলো না। এক সময় তাদের শাসনও অবসান হয়। সাম্রাজ্য বানানো তেমন কঠিন বিষয় নয়, কিন্তু সা¤্রাজ্যের দখল রাখা খুবই কঠিন। শাসক গোষ্ঠী এ চিরন্তন সত্যটি ভুলে গিয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অত্যাচারে এ সকল জনপদ প্রকম্পিত হয়েছিল। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ব্যতয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মৌলিক অধিকার হরণ, রাজনৈতিক অধিকার ভুলন্ঠিত, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ও ধর্মীয় অধিকার হরণ ইত্যাদি কারণে এ জনপদের জনগণ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।  প্রজাদের শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্যে বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় এ অঞ্চলেও ব্রিট্রিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠে। সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, ভবানী ঠাকুর, দেবী চৌধুরাণী, সূর্যসেন ওরপে কালু ও ইলা মিত্রসহ অনেকের নাম এখানে প্রণিধানযোগ্য। এছাড়াও আরো অনেকে নাম রয়েছে, যা পরবর্তীতে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। এ সকল ব্যক্তি স্বজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে।

বাঙালি তরুণ, ও কৃষক সমাজ বরাবরই বৃটিশ বিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলো। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, বিভিন্ন গোত্রে বিদ্বেষ ছড়ানো, ও ভৌগলিক বিভক্তি ইত্যাদির দোহাই দিয়েই ব্রিটিশ সাম্রারাজ্যের পতন ঠেকাতে পারেনি। ব্রিটিশ গভর্নরদের মধ্যে অনেকেই নেতিবাচক ভূমিকার জন্যে ইতিহাসে খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গভর্নর জেনারেল ডালহৌসি সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। তিনি উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল যথাক্রমে সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর, ভগৎ, উদয়পুর, ও করাউলী অঞ্চলগুলোকে স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে ইংরেজ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। এছাড়াও এ স্বত্ববিলোপ নীতির অন্যতম নেতিবাচক দিক হলো- এ আইন অনুযায়ী কোন দত্তক পুত্র পিতার সম্পত্তির উত্তারাধিকার হতে পারতো না।

ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে পারস্পারিক সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা ছিলো। আস্থা ও বিশ্বাসের কোন সংকট ছিলো না। বৃটিশরা নিজেদের শাসন কুক্ষিগত করার জন্যে বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ষড়যন্ত্র ও বিভেদ শুরু করে। তাদের শাষনের অন্যতম নীতি ছিলো- বিভাজন তৈরি কর এবং শাসন করো। তবে এ নীতি বেশি দিন ধোপে টিকে নি। ঐক্য আন্দোলন ও বিভিন্ন মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করে। জাতির সূর্যসন্তানদের কারণে বৃটিশ শাসন থেকে এ অঞ্চলের মানুষ মুক্তি পায়।

সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ ছিলেন তিনি। বাঁশের কেল্লা থেকে তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বাংলার জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে গড়ে তুলেছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে করতে গিয়ে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে শহিদ হন।

সামাজিক সংস্কার ও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন হাজী শরিয়ত উল্লাহ। তিনি ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান মাদারীপুর জেলার শ্যামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর সাথে কৃষক, তাঁতি, ও শ্রমিক শ্রেণির লোক যোগ দিয়েছিলো।

ইলা মিত্র ছিলেন নিপীড়িত মানুষের অধিকারের আদায়ের প্রতিচ্ছবি। তিনি রাজশাহী অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। জেলে অন্তরিন থাকাস্থায় তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে তিনি জেল থেকে বের হয়ে রাজনীতিতে যোগ দেন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য হন। ১৯৪৬-৪৭ সময়কালে তিনি দাঙ্গা পীড়িত এলাকায় কাজ করেন।

অনেক আগে রঙ্গপুরে এক রাণী বসবাস করতো। সেই রঙ্গপুর বর্তমানে রংপুর নামে সমধিক পরিচিত। প্রাচীনকালে এ উত্তরের জনপদটি পুন্ড্র নামক জনপদের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। এক সময় ব্রিট্রিশরা এ লোকালয় শাসন করতো। রংপুরের মাটি উর্বর হওয়াতে যে কোন ফসল এখানে চাষ করা যেতো। ইংরেজরা কৃষক প্রজাদের নীলচাষে বাধ্য করতো। কারণ এ অঞ্চলের প্রজারা নীল চাষে আগ্রহী ছিলো না। ব্রিট্রিশ শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে এ অঞ্চলে নানাবিধ বিষয় নিয়ে প্রজাদের অত্যাচার ও শোষণ করতো। মূলত, বাংলাদেশের রংপুরের মন্থনী রাজ এস্টেটের সর্বময় কর্ত্রী তেজস্বিনী নারী ছিলেন দেবী চৌধুরাণী। ঘাঘট নদীর তীরে এবং রংপুরের পীরগাছা অঞ্চলে দেবী চৌধুরাণী বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করে। ভারতের জলপাইগুড়িতে তাঁর মন্দির আছে। যেখানে তিনি ও ভবানী পাঠক আন্দোলন পরিচালনা করতেন। সময়ের পরিক্রমায় দেবী চৌধুরাণী একজন নারী বৃটিশদের ঘুম হারাম করে দেয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ দেয়। প্রজাদের কাছে তিনি গরীবের রাণী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শুধু কথায় নয়, তিনি বিপদে আপদে প্রজাদের পাশে ছিলেন। কথিত আছে, তিনি তাঁর শুশুরের কাছ থেকে টাকা ধার করে তা প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। যদিও তিনি সে টাকা আর ফেরত দেননি। এছাড়াও তিনি বৃটিশদের নিকট ডাকাত রাণী হিসেবে আখ্যায়িত ছিলেন। কারণ, তিনি জমিদারদের কাছ থেকে সম্পদ লুটতরাজ করে তা প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। ভবানী পাঠক প্রফুল্লকে দেবী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কথিত আছে যে, ভবানী পাঠক ছিলেন, ডাকাত সর্দার। তিনি ডাকাতি পরিচলনা করলেও সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতেন। দেশীয় জমিদার ও অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের উপর লুঠতরাজ করে তা দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। তাঁর সহযোগী ও শিষ্যা ছিলেন দেবী চৌধুরানী।

পলাশির আম্রকাননে সতেরোশত সাতান্ন খ্রিষ্টাব্দে বাংলার যে স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তা আবার উদিত হয়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে বৃটিশদের নিকট পরাজিত হওয়ার কারণে দীর্ঘ দিন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হয়। মীরজাফর বঙ্গদেশের ইতিহাসে খলনায়কের চরিত্রে নিজেকে স্থান দেয় এবং সবসময় ধিক্কার উচ্চারিত হয়। তাঁর ও দোসরদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বাংলায় স্বাধীনতার সূর্য দীর্ঘদিন অস্তমিত থাকে। অবশেষে দীর্ঘ প্রায় দু’শত বছরের পর ঊনশত সাতচল্লিশ খ্রিষ্টাব্দে এ জনপদ বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়।

লেখক,          

মোঃ হাবিবুর রহমান

কবি ও গবেষক ,

ই-মেইল: [email protected]

 

 

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2020