মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট: জাতিগত সংঘাত এবং সমাধান শীর্ষক বইটি কুদরেত বুলবুল, মোঃ নাজমুল ইসলাম এবং মোঃ সাজিদ খান কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় সম্পাদিত হয়েছে (ROHINGYA REFUGEE CRISIS IN MYANMAR: ETHNIC CONFLICT AND RESOLUTION- Edited by Kudret Bulbul, Md. Nazmul Islam and Md. Sajid Khan)। এ বইটি বিশ্বের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান- স্প্রীঞ্জার লিংক (https://link.springer.com/book/10.1007/978-981-16-6464-9) থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থান, গণতন্ত্রকামী নেতাদের আটক করাসহ বিভিন্ন বিষয় এই বইটিকে আরও প্রাসঙ্গিক এবং সময়োপযোগী করে তুলেছে। মিয়ানমারে সংঘটিত বিষয়গুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থান এবং ২০২১ সালে জারিকৃত পরবর্তী জরুরি ঘোষণার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে হতবাক করেছে৷ সম্পাদিত এই বইটিতে এ দেশের ইতিহাস, নীতি, ও রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় আলোচনার পাশাপাশি মিয়ানমারে জাতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের বর্তমান সঙ্কটের কারণ বিশ্লেষণ হয়েছে৷ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জাতিগত সংঘাত এবং তা সমাধানের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। উপরন্তু, চীন, ভারত,ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং “বৃহৎ শক্তি” দ্বারা যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বিভিন্ন নীতির চ্যালেঞ্জ এবং বর্তমান সমস্যাগুলির একটি সামগ্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এ বইটিতে চীন, ভারত, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক নীতি এবং রাজনীতিতে আরও বেশি দৃষ্টিপাত করে এমন বিষয়সমূহ যেমন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সঙ্কটের আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতির মেরুকরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এ গ্রন্থে নিম্নোক্ত বিষয়াবলী পর্যালোচনা করা হয়েছে, যেমন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির প্রকৃত কার্যক্রম বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে কিনা? অধিকন্তু, এই বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে যে, ভারত এবং চীনের মতো আঞ্চলিক দেশগুলি কেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আগ্রহী এবং এই মানবিক দুর্বলতা সমাধান করতে তাঁরা ইচ্ছুক কি না? নাকি তারা এই সমস্যাটিকে তাদের পররাষ্ট্র নীতির পরিপন্থী বলে বিবেচনা করে। এছাড়াও এই বইটিতে বাংলাদেশ ও ভারতের গণমাধ্যমে পূর্বে অল্প পরিচিত, তথাপি বহুল আলোচিত ভূমিকা, পশ্চিমা ও তুরস্কের উদ্যোগসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আইএনজিও এবং এনজিওর মানবিক অবদান, মিয়ানমার সরকারের নীতি ও রাজনীতি এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও এ গ্রন্থে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের চ্যালেঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে রোহিঙ্গাদের মামলা কীভাবে যাচাই করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে৷ এ বইটি রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে মানব পাচারের মতো বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত বিশেষ কেস স্টাডি, ও বৈশ্বিক অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উদাহরণ এবং অভিজ্ঞতার সাহায্যে মানবিক ভিত্তিক সমাধানগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে৷
সম্পাদিত এই বইটিতে ষোলটি (১৬) অধ্যায় রয়েছে। এ সকল পরিচ্ছদের কাঠামোর মধ্যে ইতিহাস ও রাজনীতির বাইরে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে। এই বইটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে সম্পাদন করা হয়েছে যেখানে বর্ণনামূলক, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং মাঠপর্যায়ের তথ্য ও উপাত্ত রয়েছে যা মূলত পূর্ববর্তী গবেষণা প্রবন্ধ থেকে সংকলিত হয়েছে। এই বইটিতে বিশিষ্ট পণ্ডিত, গবেষক, উন্নয়নকর্মী, গণমাধ্যম বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ এবং একাডেমিশিয়ানদের অবদান রয়েছে যারা রাজনীতি, উদ্বাস্তু, অভিবাসন, মিডিয়া, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুপরিচিত ও প্রাজ্ঞজন। এছাড়াও এ সকল লেখক ও গবেষকগণ শরণার্থী, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জাতিগত সংঘাত এবং সমাধানের বাইরে রোহিঙ্গা সংকটের নীতি ও রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী ও বিশ্লেষক। সর্বোপরি, এ গ্রন্থের বিশ্লেষণাত্মক বিভাগে বেশ কিছু বিষয়ভিত্তিক ইস্যূ, তাত্ত্বিক এবং পরীক্ষামূলক অন্যান্য আলোচনা এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে সহযোগী অধ্যাপক ড. আলী দ্বাদন এবং আব্দুর রহমান ফুয়াদ ”রোহিঙ্গাদের প্রাক-ঐতিহাসিক পরিচয়: আরাকানে ইসলামের অন্বেষণ এবং মুসলিম রাজ্যের ঐতিহাসিক পরিচয়” নিয়ে আলোচনা করেছেন । দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডক্টর নেবিল পেলিন মানটি এবং অ্যাডভোকেট দিলারা নুর কানসু ইসলাম মিয়ানমারে “গণহত্যা, জোরপূর্বক অভিবাসন, এবং জোরপূর্বক শ্রম: রোহিঙ্গাদের উপর একটি কেস স্টাডি নিয়ে আলোকপাত করেছেন। অন্যদিকে তৃতীয় অধ্যায়ে মোঃ সাজিদ খান এবং নুরেফসান আরিকাম ফোর্সড মিয়ানমারে মাইগ্রেশন এবং মানব পাচার বিশ্লেষণ: দক্ষিণ এশিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। এছাড়াও আসিফ বিন আলী চতুর্থ অধ্যায়ে “মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নীতি ও রাজনীতি” নিয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন।
পঞ্চম অধ্যায়ে শরিফুল ইসলাম মিয়ানমারে “আশ্রিত শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের স্বার্থ: রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া” নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। অন্যদিকে মোঃ নাজমুল ইসলাম এবং মোঃ হাবিবুর রহমান ষষ্ঠ অধ্যায়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বৈদেশিক নীতির বিপরীতে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম’সম্প্রদায়ের জাতিগত সংখ্যালঘুর সংকট সম্পর্কিত প্রশ্ন তুলে তার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিকে নিয়ে আলোকপাত করেছেন।
সপ্তম অধ্যায়ে সহযোগী অধ্যাপক মোঃ ইশতিয়াক আহমেদ তালুকদার “শরণার্থীরা কি আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ: বাংলাদেশের উপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অর্থনৈতিক প্রভাবের বিশ্লেষণ” নিয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়া অষ্টম অধ্যায়ে অধ্যাপক ড. বেদাত ইসিখান এবং মোঃ সাজিদ খান “রোহিঙ্গা’ শরণার্থীদের বাইরে: বিশ্বের ‘সবচেয়ে নির্যাতিত উদ্বাস্তু’-এর জন্য ভারতের নীতি এবং বাস্তব রাজনীতি” নিয়ে আলোকপাত করেছেন। অন্যদিকে নবম অধ্যায়ে ফয়সাল মাহমুদ, মোঃ নাজমুল ইসলাম এবং মোঃ সাজিদ খান “রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বৈদেশিক নীতি: রাখাইন রাজ্যে চীনের নীতি এবং স্বার্থ” বিষয়াবলী পরীক্ষা করেছেন।
দশম অধ্যায়ে জনাব নুরেফসান আরিকাম, মোঃ নাজমুল ইসলাম, জনাব লুৎফুন নাহার এবং জনাব এসরা আইমেন ক্যানসু মিয়ানমারে “মানবতাবাদী পক্ষ হিসাবে তুরস্ক: বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা” বিষয়াবলী তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে একাদশ অধ্যায়ে মোবাশ্বেরা জাহান ফাতিমা এবং সহযোগী অধ্যাপক ড. আইতুল তামের তোরুন বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতিনিধিত্ব: বিষয়বস্তু বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেছেন ।
দ্বাদশ অধ্যায়ে জনাব কনিকা ওয়ালিয়া এবং প্রফেসর ড. সেরদার ওজতুর্ক “গণমাধ্যমের মাধ্যমে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংকট: ভারতীয় প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। এছাড়া ত্রয়োদশ অধ্যায়ে গারসন দাগবা এবং জনাব ইসরাইল নায়াবরুী নায়াদারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগের অবস্থান: রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া- পশ্চিমা দেশগুলির কেস” নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।
চতুর্দশ অধ্যায়ে জনাব আগ্না সুজাত, মোঃ সাজিদ খান এবং মোঃ নাজমুল ইসলাম, “বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে সামাজিক সংহতির জন্য আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থা (আইএনজিও) এবং এনজিওর কৌশল ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে পনেরোতম অধ্যায়ে সানজিদা পারভীন এবং ড. মেহেবুব সাহানা রোহিঙ্গাদের “পরিচয় এবং মানবিক সম্পর্কিত পদ্ধতি: রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধান এবং সংশ্লিষ্ট সমাধান”-নিয়ে আলোকপাত করেছেন। চূড়ান্ত পরিচ্ছদ তথা ষোলতম অধ্যায়ে রোহিঙ্গা নিয়ে “অতীতের দিকে তাকানো, ভবিষ্যৎ পরিবর্তন: রোহিঙ্গাদের দর্শন থেকে গল্প” নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এ গ্রন্থটি রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, জাতিগত এবং নীতিগত সংকট সম্পর্কিত একটি অধ্যয়ন যা দক্ষিণ এশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ এবং আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এই সম্পাদিত বইটি ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমালোচক, সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃতত্ত্ববিদদের পাশাপাশি আরও সাধারণ পাঠক, নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিকদের জন্য উপযুক্ত বই বলে বিবেচিত হবে বলে আমি মনে করি।
আমার মতে, এ বইয়ের সম্পাদকগণ রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় জাতিসংঘের (ইউএনও) ভূমিকাকে এড়িয়ে গেছেন । যেখানে এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এককভাবে দায়ী। অন্যদিকে কিছু নিবন্ধ নৃতাত্ত্বিক বিবরণ পরিহার করেছেন । কারণ সম্পাদকগণ ও লেখকগণের বিশ্লেষণ এবং আলোচনা ও বিশ্লেষণ মূলত মাধ্যমিক তথ্য ও উপাত্তের উপর ভিত্তি করে সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়াও এ গ্রন্থে খাদ্য নিরাপত্তা, রোহিঙ্গাদের আগমনের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নারী ও শিশু পাচার, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি, পরিবেশগত নিরাপত্তাহীনতা এবং সমস্যাগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এছাড়াও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যে বিতর্ক তথা তারা কি রোহিঙ্গা শরণার্থী, নাকি বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের জনগণ এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। এ সকল বিষয়াবলী আলোচনায় আনলে এ বইটির গুরুত্ব আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেত। সর্বোপরি এ গ্রন্থটি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিরসনে একাডেমিক ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উম্নোচিত হয়েছে, যা ইতিবাচক। পরবর্তীতে এ বিষয়ে গবেষণা ক্ষেত্রে এ বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক,
মোঃ হাবিবুর রহমান
কবি, লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected] এবং [email protected]