1. [email protected] : thebanglatribune :
ছাত্ররাজনীতির অনন্য দৃষ্টান্ত তানভীর হাসান সৈকত - The Bangla Tribune
মার্চ ২৯, ২০২৪ | ২:২৭ অপরাহ্ণ

ছাত্ররাজনীতির অনন্য দৃষ্টান্ত তানভীর হাসান সৈকত

  • প্রকাশের সময় : সোমবার, জুলাই ১৮, ২০২২

অনেক ধনাঢ্য রাজনীতিবিদগণ করোনার বৈশ্বিক মহামারির প্রাক্কালে তেমন একটা সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। মাহরারির প্রাদুর্ভাবের সময়ে বেশির ভাগ নেতাই লাপাত্তা ছিলেন। খাদ্য কষ্ট নিয়ে সাধারণ মানুষ যখন দিশেহারা, তখন মানবিকতার তাগিদে মুষ্টিমেয় কিছু লোক বা রাজনৈতিক নেতা পর্যাপ্ত খাদ্য সহযোগিতা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন অবহেলিত এলাকায়। তেমনি একজন ছাত্রনেতার মানবকিতাবোধ সকলের প্রসংশা কুড়িয়েছে। ছেলেবেলায় পাইলট হয়ে আকাশে ওড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকলেও স্কুলজীবনে এসে রাজনীতির প্রতি প্রবল টান অনুভব করেন। সময়ের বাঁকবদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জনপ্রিয় ছাত্রনেতা নিজের যোগ্যতায় ছাত্ররাজনীতিতে একটা আলাদা জায়গা তৈরি করেছেন। করোনায় মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য জাতিসংঘ থেকে পেয়েছেন ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ স্বীকৃতি। তিনি হলেন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-সমাজসেবা সম্পাদক এবং ডাকসুর সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। অদম্য আত্মপ্রত্যয়ী সৈকতের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে এই পর্যন্ত আসা এবং রিয়েল লাইফ হিরো হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে বিবিধ ঘটনা। ফিরে আসি সেইসব ঘটনাবলী থেকে।

সৈকতের জন্ম লক্ষ্মীপুর জেলা সদরে। বাবা পেশায় আইনজীবী হলেও স্বপ্নপূরণে বেছে নিয়েছেন শিক্ষকতাকে। বাবার আজন্ম স্বপ্ন ছিল একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার। শেষে আইনপেশা ছেড়ে ‘লক্ষ্মীপুর পৌর কিন্ডার গার্ডেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাও পেশায় শিক্ষক। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সৈকত সবার বড়।

সৈকতের দাদা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ ভক্ত। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে মানুষের সেবা করে গেছেন। তাঁর দাদা লক্ষ্মীপুর পৌর আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। গ্রামে কারো কোনো সমস্যা হলে নিজে গিয়ে সমাধান করতেন। দলের কেউ বিপদে পড়লে নিজের জমি বিক্রি করেও আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন। কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। পিতামহের এইসব কর্মকাণ্ড দেখে দেখে বড় হয়েছেন সৈকত।

সৈকতর দাদা সবসময় তাঁকে রাজনৈতিক সভা-আলোচনায় কোলে করে নিয়ে যেতেন। এভাবে তিনি কখন যে সৈকতের শিশুমনে রাজনীতির বীজ বুনে দিয়েছেন সেটা বুঝে উঠতে পারেনি সৈকত। মেঝো কাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল। কলেজ জীবনে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকসুর কালচারাল সেক্রেটারি ছিলেন। ছিলেন সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্রলীগের সভাপতি। বাবা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও পরবর্তীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে সবসময় সৈকতের বাড়িতে নেতারা আসা-যাওয়া করতেন। তারা রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। এগুলো সৈকতকে রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলে।

হাইস্কুলে এসে রাজনীতির বিষয়ে জানার আগ্রহটা আরো তীব্র হয় সৈকতের। তিনি বলেন, বিএনপি-জামাতের সময়ে বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হতো। ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান’ বলে পড়ানো হতো। রবীন্দ্র চক্রবর্তী নামে আমাদের ইতিহাসের একজন শিক্ষক ছিলেন। বই পড়ানো শেষ করে তিনি বলতেন, এবার বইটা বন্ধ করো। এতক্ষণ যা পড়েছো সেসব ছিলো মিথ্যে। এখন সত্যটা বলি, সবাই মন দিয়ে শোন। তখন তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনাদর্শ, কাজ, দেশ ও মানুষের জন্য লড়াই-সংগ্রামের গল্প বলতেন। ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভুত্থান, স্বাধীনতার যুদ্ধ এসব বিষয়গুলো যতই জেনেছি ততই আশ্চর্য হয়েছি। অবচেতন মনে রাজনীতির প্রতি আমার ভেতরে আলাদা একটা ভালোলাগা শুরু হয়।

স্কুলজীবন থেকেই নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে সৈকতের। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্কুলে বিভিন্ন আয়োজনে নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করতেন। তিনি বলেন, ছাত্র হিসেবে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। খুব দুষ্টু ছিলাম, তবে বেয়াদব না। স্পষ্টভাষী ও প্রতিবাদী ছিলাম। যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম। আমার ব্যবহার ও নেতৃত্বের গুণাবলীর জন্য শিক্ষকরা আমাকে খুব আদর করতেন।

এভাবে স্কুলের স্বর্ণালি সময়টা খুব দ্রুত ফুরিয়ে পৌর শহীদ স্মৃতি একাডেমি, লক্ষ্মীপুর থেকে এসএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষা জন্য চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকা সিটি কলেজে। কলেজ ক্যাম্পাসে এসেই যুক্ত হন ছাত্ররাজনীতির সাথে।

পড়াশোনা ও ছাত্ররাজনীতির ব্যস্ততায় কেটে যায় কলেজের স্মৃতিময় দিনগুলি। এইচএসসি শেষ করে তিনি শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি। সংস্কৃতির প্রতি আর্কষণের কারণে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পার্ফমেন্স স্টাডিজ বিভাগে। ভর্তি হয়ে ঢাবির জসীম উদদীন হলে ওঠেন। শুরু হয় ছাত্রজীবনের নতুন অধ্যায়। হলের প্রথমদিন থেকেই তিনি ছাত্র রাজনীতির কার্যক্রমের সাথে সক্রিয় যুক্ত ছিলেন।

৫ জানুয়ারি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বকশীবাজারে বিএনপি-জামাত ছাত্রলীগের উপরে যে হামলা করে, ওই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন।

তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ এবং ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান মোল্লা ভাই সৈকতের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় পড়াশোনায় এক বছর নষ্ট করতে হয়। সুস্থ হয়ে নিয়মিত ক্লাস শুরু করেন। সেইসাথে ঢাবির ছাত্রলীগের সকল কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ফলে ঢাবি ছাত্রলীগের সদস্য এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকরী সদস্য করা হয় তাঁকে।

২০২০ সালের মার্চ মাস।করোনায় বাংলাদেশে এর প্রকোপ বেড়েছিল ব্যাপকভাবে। আক্রান্ত হচ্ছিল লাখো মানুষ। দীর্ঘ হচ্ছিল লাশের মিছিল। এই পরিস্থিতিতে ১৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। সব শিক্ষার্থীরা যখন বাড়ি চলে যান, তখন সৈকতের মাথায় আসে একটা ব্যতিক্রমী ভাবনা। যেই ভাবা সেই কাজ। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে টিএসসিতে ছিন্নমূল ভাসমান-অসহায় মানুষের খাবারের ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। ২৪ মার্চ, নিজের জমানো ১৩ হাজার টাকা দিয়েই অসহায় মানুষের খাবার দেয়া শুরু করেন তিনি।

সৈকত একটা জিনিস নিশ্চিত ছিলেন, ভালো কাজে কখনো আর্থিক সংকট বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তাই নিজের যা সম্বল ছিল তা দিয়েই এই উদ্যোগ শুরু করেন। প্রথম দিন খাওয়ানোর পর বিষয়টা নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেন। ওই স্ট্যাটাসে সাড়া পেতে শুরু করেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সমাজ সেবক, সাংবাদিক, পুলিশ, রাজনীতিবিদসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

করোনা মহামারীর শুরু থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় লকডাউনে ১২১ দিন টিএসসি এলাকার ভাসমান মানুষদের দুইবেলা খাবারের ব্যবস্থা করেন সৈকত। প্রতিদিন দু’বেলা গড়ে হাজার খানেক মানুষকে খাইয়েছেন। এরপর দেশে করোনা প্রকোপ কিছুটা কমে এলে বন্যা শুরু হয়। তখন তিনি সুনামগঞ্জে চলে যান বন্যা কবলিত মানুষকে সহায়তা করতে। একইভাবে শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেবামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।

তাঁর এ মানবিক কাজের জন্য তাঁকে‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। ২০২০ সালে ১৯ আগস্ট বিশ্ব মানবিক দিবস উপলক্ষে মানবিক কাজে অনুপ্রেরণা যোগাতে জাতিসংঘ তাঁকে বিশেষ এই স্বীকৃতি দেয়।

অনুভূতি ব্যক্ত করে সৈকত জানান, জাতিসংঘের মতো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া গর্বের ব্যাপার। জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি ভবিষ্যতে গণমানুষের জন্য কাজ করতে উৎসাহ যোগাবে, আমার কাজের গতি বাড়িয়ে দিবে৷ ভবিষ্যতে দেশের মানুষের জন্য পূর্বের মতোই কাজ করে যেতে চাই।

করোনাকালে ছিন্নমূল মানুষের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে যারা আর্থিকভাবে, খাবার দিয়ে এবং পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সৈকত। বিশেষ করে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে।

সৃজনশীল কাজ করতে ভীষণ পছন্দ করেন সৈকত। টিএসসির পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৩ নম্বর গেটের সামনে বসে একদিন চা খাচ্ছিলেন। পাশেই ছিল ময়লা আর্বজনার স্তুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ যে কেউ এখানে এসে চায়ের আড্ডা দিতে দিতে প্রয়োজনীয় বই যাতে সংগ্রহ করতে পারে- বিষয়টি নিয়ে কয়দিন ভাবেন। পরে সেই ভাবনা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে একটি উন্মুক্ত লাইব্রেরি তৈরি করেন।

উন্মুক্ত লাইব্রেরির ভেতরটা সাজানো-গোছানো। কালো কাঠের পাটাতনের ওপর তিন তাকওয়ালা কাঠের একটি রঙিন বুকসেলফে সাজানো আছে বই। সৌন্দর্য বাড়াতে রাখা হয়েছে বাহারি গাছ। এছাড়াও পাঠাগারটির একপাশে সাজানো হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত নানা ছবি। আঁকা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচু করা ছবি, যা মনের করিয়ে দেয় ৭ মার্চের সেই ঐতিহসিক ভাষণের কথা। এই লাইব্রেরিতে এখন প্রায় ১৮০০ বই রয়েছে ।

থিয়েটারের প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা ও ভালোবাসা থেকেই থিয়েটার অ্যান্ড পার্ফমেন্স-এ ভর্তি হন সৈকত। ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি ক্লাসের পড়াশোনা ও প্র্যাকটিকেল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক সৃজনশীল কাজ করেছেন এই নাট্যপরিচালক। অবহেলিত পথশিশু, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সমাজ সচেতনতামূলক পথনাটক করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পার্ফমেন্স স্টাডিজ বিভাগে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছেন অদম্য এই ছাত্রনেতা। এছাড়াও তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফিল্ম সোসাইটির সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য।

তরুণ এই ছাত্রনেতা এশিয়ার সবচেয়ে বড় একটা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেন। যেখানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষেরা এসে বই সংগ্রহ করবে। বই পড়বে। এটা ব্যক্তি উদ্যোগে সম্ভব না। এর জন্য সরকারের সাহায্য দরকার।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে ‘উন্মুক্ত লাইব্রেরি’ প্রতিষ্ঠা তাঁর স্বপ্নযাত্রার প্রথম অধ্যায় তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন দেশের প্রত্যেকটি জেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্মুক্ত লাইব্রেরির প্রচলন হবে।

প্রতিবেদক

মোঃ কামাল উদ্দিন

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2020