1. mskamal124@gmail.com : thebanglatribune :
  2. wp-configuser@config.com : James Rollner : James Rollner
আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে পদ্মা সেতু এক মাইলফলক - The Bangla Tribune
এপ্রিল ২৯, ২০২৫ | ৩:৫৮ পূর্বাহ্ণ

আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে পদ্মা সেতু এক মাইলফলক

  • প্রকাশের সময় : সোমবার, জুলাই ১১, ২০২২
লেখক ও কবি মোঃ হাবিবুর রহমান

পদ্মা সেতু বহুমুখী প্রকল্প ও নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের কারণে এ সেতু বাস্তবায়ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। অবশেষে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এ বিরাট কর্মযজ্ঞের পরিসমাপ্তি হয়ে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হলো। ২৫ জুন, ২০২২ খ্রি. তারিখে পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো। বাংলাদেশে অন্যান্য সেতুর তুলনায় এ সেতু বিভিন্ন মানদণ্ডে এগিয়ে আছে। পদ্মা সেতু মূলত সড়ক-রেল বহুমূখী সেতু যা পদ্মা নদীর উপর নির্মিত হয়েছে। এটা বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু। এ সেতুটি মূলত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঢাকাকে সংযুক্ত করছে। এটা মুন্সিগঞ্জের লৌজং-এর মাওয়াকে শরিয়তপুরের জারিরা এবং মাদারীপুরের সাথে সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে সংযুক্ত করছে। এ সেতুর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ১০.৬৪২ কি.মি হলেও মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কি.মি.। এ সেতুর নির্মাণ ব্যয় আনুমানিক ৩০,১৯৩.৩৯ কোটি টাকা মাত্র। এ সেতু সম্পন্নকরণের জন্যে ১৪৭১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করার পাশাপাশি ১৪ কি.মি পর্যন্ত নদীশাসন করতে হয়েছে।

 

বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মিত হওয়ায় দেশে ও বিদেশে অনেক প্রশংসনীয় এবং সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এ সেতু বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। এ সেতুটি নির্মাণের পরিকল্পনা অনেক আগেই হাতে নেওয়া হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় পদ্মা সেতুর এক ধারাবাহিক অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৮-১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি অর্থয়ানে এ সেতুর ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়। ২০০৩-২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে জাইকা, জাপান এর অর্থায়নে সেতু স্থাপনের সক্ষমতা যাচাই করা হয়। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি অর্থায়নে জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা, রিস্যালেটম্যান্ট একশন প্ল্যান এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কাজ সম্পন্ন করা হয়। ২০০৯-২০১১ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়ান ডেলেপম্যান্ট ব্যাংকের ঋণ সহায়তা এবং সরকারি অর্থায়নে এ সেতুর বিস্তারিত নকশা ও প্রকিউরম্যান্ট সম্পন্ন করা হয়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে বিশ^ব্যাংক এ সেতুতে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাতিল করে। এমতাবস্থায় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করে। যা উন্নয়ন ডিসকোর্সে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ জুন সেতুর মূল অংশ নির্মাণের জন্যে চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের সাথে বাংলাদেশ সরকার চুক্তি করে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ নভেম্বর এ সেতুর মূল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের মাওয়াতে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যান স্থাপন করা হয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ স্প্যান স্থাপন সম্পন্ন করা হয়। এ সেতুটি ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সামলে দেয়ার সক্ষমতা রাখে।

 

বাংলাদেশের অন্যান্য সেতুর তুলনায় এ সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল ও টোল আদায় এক মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। ২০২২ সাল নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ২৪,০০০ যানবাহন এ সেতুটি দিয়ে অতিক্রম করবে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এছাড়াও ২০৫০ সাল নাগাদ এ সেতু দিয়ে ৬৭,০০০ যানবাহন অতিক্রম করবে বলে লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এর মতে, গত তিন দিনে (১০ জুলাই, ২০২২) পদ্মা সেতু থেকে টোল আদায় হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা (প্রায় দশ কোটি সাতান্নব্বই লাখ নয় হাজার ছয়শত টাকা)।

 

পদ্মা সেতু সম্পন্ন হওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন যোগাযোগ, পর্যটন, অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। মাওয়া এবং জারিরায় ফেরি চলাচল ও রক্ষণাবেক্ষণের কারণে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার অপচয় থেকে রক্ষা পাবে। ঢাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি যোগযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হয়েছে। এছাড়াও এ অঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১.৭% বৃদ্ধি এবং দেশব্যাপী জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ০.৫৬% বৃদ্ধি পাবে। নদী শাসনের ফলে নদীক্ষয় এবং বন্যা থেকে রক্ষা পাবে যা প্রায় ১৫৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার অপচয় থেকে অর্থ রক্ষা পাবে। বাংলাদেশের নির্মাণক্ষেত্র, কৃষি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। যেমন এ সেতুর ফলে নির্মাণক্ষেত্রে ২৯%, কৃষি ক্ষেত্রে ৯.৫%, এবং যোগাযোগ এবং ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে ৮% প্রবৃদ্ধি বাড়বে। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হবে। কৃষকরা ন্যায্যমূল্যে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে যা পূর্বে অনেকাংশে সম্ভব ছিলো না। ঢাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগে এক চতুথাংশ সময় অপচয় থেকে রক্ষা পাবে। বাংলাদেশের রাজধানীর সাথে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে যোগাযোগ স্থাপনে ২ থেকে ৪ ঘন্টা সময় অপচয় থেকে রক্ষা পাবে। তাছাড়া যোগাযোগ ও পর্যটনক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হবে। মংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরে গতিশীলতা লাভ করবে। দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটনস্থান বিশেষ করে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ও ষাটগম্বুজ মসজিদে পর্যটকদের পরিভ্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। দেশের দারিদ্র্যের হর ০.৮% কমবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১% দারিদ্র্যের হার কমবে। এ সেতুর কারণে আঞ্চলিক যোগাযোগে গতিশীলতা লাভ করবে। প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের যোগাযোগের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। ভারত, নেপাল এবং ভুটানের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হবে।

 

এ সেতু সম্পন্ন হওয়ার ফলে অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন। এছাড়াও তিনি তার প্রবন্ধে নিম্নোক্ত বিষয়াবলি তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে দক্ষিণ এশিয়াসহ স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। সহ্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বাংলাদেশ ইতিবাচক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন সূচকে অন্যান্য দেশের তুলনায় সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নিত হওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা অর্জন করার জন্যে সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করা প্রয়োজন। ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ দিকে পদ্মা সেতু সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে নদীর উভয়পাশের জনগণের যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। একটি ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়ন যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে তা এ সেতুর মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এ সেতুর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো বৃদ্ধি পাবে। এ সেতুর মাধ্যমে প্রায় ২১টি জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষ উপকৃত হবে। কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। যোগাযোগ, সাপ্লাই চেইনে গতিশীলতা, পণ্য ও সেবা সহজলভ্যকরণ, শিক্ষা স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সেবা পেতে এ অঞ্চলের মানুষের বিড়ম্বনা ও কষ্ট লাঘব হবে। গ্রামের সাথে নগরায়নের যোগাযোগ স্থাপনে আরো গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। মাইক্রো ও ম্যাক্রো অর্থনীতির সংযোগ ভালোভাবে স্থাপিত হবে। পরিশেষে এ সেতু সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের আত্নবিশ্বাস আত্নবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

পদ্মা সেতু সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাব-গাম্ভীর্য, স্বনির্ভরতা, সাহসীকতা, গর্ব এবং উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনায় এক নতুন সংযোজন হয়েছে। বাংলাদেশ বিশে^র অন্যান্য নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের জন্য এক নজির স্থাপন করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে বৈদেশিক সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া যে বিরাট প্রকল্প সম্পন্ন করা সম্ভব। তা বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ সেতু ব্যাপক অবদান রাখবে বলে সকলের প্রত্যাশা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনএক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ সেতুর কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্যে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ জনগণসহ সংশ্লিষ্ট সকললে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে পদ্মা সেতু ব্যাপক অবদান রাখবে বলে বিশ্বাস করছি।

লেখক,

মোঃ হাবিবুর রহমান

কবি ও গবেষক ,

ই-মেইল: mirmohammadhabib@gmail.com

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2020